সবসময় সমসাময়িক লাকী আখন্দ

১৭ ডিসেম্বর ২০১৭, ০৬:৩৯ এএম | আপডেট: ২৬ মার্চ ২০২৪, ১২:০৮ পিএম


সবসময় সমসাময়িক লাকী আখন্দ
ফাহিম ইবনে সারওয়ার লাকী আখন্দ টাকার জন্য গান করেননি। গান করেছিলেন ভালোবেসে। আর তাই যা করেছেন তাতে প্রাণ ছিল ভরপুর। সেই সত্তুর কিংবা আশির দশকে লাকী আখন্দের করা গান, এখনো আমাদের প্রজন্ম গলা খুলে গায়। আর এখনকার শিল্পীদের গানগুলো বড্ড কমার্শিয়াল, টাকার জন্য গান। তাইতো দুইদিন পর আর খুঁজে পাওয়া যায় না। লাকী আখন্দের গান চলেছে সুর, কথা আর গায়কীর জোরে, মিউজিক ভিডিও লাগেনি। ‘ঘুড্ডি’ ছবিতে লাকী আখন্দের করা বিখ্যাত গান ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’। সেই গানের দৃশ্যায়নের বিষয়ে ইন্টারেস্টিং একটা গল্প শুনেছিলাম। ছবির শুটিং শেষ, অল্প কিছু রিল বাকি আছে। গানের শু্যটটা তখনো বাকি। কক্সবাজারের সৈকতে সুবর্ণা মুস্তাফা আর রাইসুল ইসলাম আসাদ। ক্যামেরা অন হলো, বলা হলো যতটুকু নেগেটিভ আছে তার মধ্যেই গানটা টেক করতে হবে। বাকি রিল দিয়েই গানের শুটিং শেষ করা হলো। ‘ঘুড্ডি’ ছবির মিউজিক ডিরেক্টর ছিলেন লাকী আখন্দ। ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’ গানটি গেয়েছিলেন লাকীর ছোট ভাই হ্যাপি আখন্দ। ছবিতে অভিনয়ও করেছিলেন হ্যাপি। চমসৎকার কথার গানটা লিখেছিলেন কাওসার আহমেদ চৌধুরী। হ্যাপিও ছিলেন খুব গুনী একজন মিউজিশিয়ান। লাকী-হ্যাপি ছিলেন জুটি। হ্যাপি মারা যান ১৯৮৭ সালে। এরপর থেকেই গানে অনিয়মিত হয়ে পড়েন লাকী আখন্দ। ১৯৯৮ সালে ঢাকায় প্রথম গান করতে আসেন অঞ্জন দত্ত। অঞ্জনও প্রভাবিত হয়েছিলেন লাকী আখন্দের সঙ্গীত জ্ঞান এবং ব্যক্তিত্বে। আর তাই নিজের ‘হ্যালো বাংলাদেশ’ অ্যালবামে ‘লাকী আখন্দ’ নামে একটা গানও গান অঞ্জন দত্ত। আজকাল কলকাতা থেকে কোন সেলিব্রেটি আসলে আমাদের সেলিব্রেটিরা যেভাবে সেলফি তোলার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠেন তাদের থেকে একদম আলাদা ধাতুতে গড়া ছিলেন লাকী আখন্দ। তিনি প্রভাবিত হওয়ার বদলে উল্টো প্রভাবিত করেছিলেন অঞ্জন দত্তকে। একেই বলে ব্যক্তিত্ব। অঞ্জনের কোন গান শোনেননি বলেও অকপট জানিয়েছিলেন তিনি অঞ্জনকে। কিন্তু দুজন দিব্যি স্টেজ মাতিয়ে গান করেছেন একসাথে। এরপর দুজনের মধ্যে আর তেমন যোগাযোগ ছিলো না। হ্যাপি আখন্দ, কুমার বিশ্বজিৎ, ফাহমিদা নবী থেকে জেমস। সবার জন্য গান সুর করেছেন লাকী আখন্দ। জেমসের গলায় বিখ্যাত হওয়া গান, ‘ভালোবেসে চলে যেতে নেই’ এবং ‘লিখতে পারিনা কোন গান’ লাকী আখন্দের সুর করা। অদ্ভূত লাকী আখন্দ! তাঁকে কোন সময়ে বাধা যাবে না। তিনি সবসময় সমসাময়িক। আমরা তাঁকে ধরে রাখতে পারিনি। তাঁকে মূল্যায়ন করতে পারিনি। সেজন্য তাঁর কোন মাথাব্যথাও ছিলো না। আমাদের সাময়িক ‘সোশ্যাল শোক’ হয়তো কেটে যাবি কিন্তু লাকী আখন্দ চিরকাল থেকে যাবেন। আপনাকে স্যালুট লাকী আখন্দ। পারলে আমাদের ক্ষমা করে দেবেন। অঞ্জনের ‘লাকী আখন্দ’ : ১৯৯৮ এর এপ্রিল মাস নাগাদ আমি প্রথম বাংলাদেশ যাই,গান গাইতে। ঢাকার ন্যাশনাল মিউজিয়াম অডিটরিয়ামে আমাদের শো। প্রথমবার ঢাকা, হলভর্তি শ্রোতা, দারুন লাগছে।হঠ্যাৎ শোয়ের মাঝামাঝি আমাদের জলসার উদ্যোক্তা নিমা রহমান আমায় জানান, যে হলে একজন শিল্পী উপস্থিত, যিনি এক সময় খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। তাকে আমি চিনি না। তার গানও কখনো শুনিনি। কিন্তু একেবারেই নিছক আসর জমানোর উদ্দেশ্যে হঠ্যাৎ তাকে মঞ্চে আসতে আহ্বান করলাম। তিনিও দিব্যি উঠে এলেন এবং আমার সঙ্গে গানবাজনা করতে শুরু করে দিলেন। যদিও তাকে যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমার কোন গানটা গাইবো বলুন তো? তিনি বলেছিলেন, আমার গান তিনি আদৌ শোনেননি! দিব্যি গান গাওয়া হলো। আসর জমে গেল। বহু বছর যে শিল্পী গান গাওয়া বন্ধ করে চুপ মেরে বসেছিলেন, হঠ্যাৎ আবার গান গেয়ে উঠলেন। তারপর তার সঙ্গে তেমনভাবে আর কোন যোগাযোগ হয়নি। কিন্তু যে কারণে এসব কথাগুলো বলছি তা হলো, জীবন খুব কমই আমি অন্য কোন শিল্পীর সঙ্গে গান গাইতে গিয়ে এতটা এনজয় করেছি। তাই ভাবলাম গল্পটা আপনাদের বলি, দুজনে থাকে দুটো দেশে দুজনেই গান বেঁচে খায় গানে গানে কোন এক মঞ্চে হঠ্যাৎ দেখা হয়ে যায় একজন বাজায় গিটার আরেকজন কীবোর্ডস একজন গান গেয়ে চলে আরেকজন দেয় সঙ্গ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় গান সেদিনের সেই জলসায় একাকার হয়ে যায় ঠিকানা কলকাতা কিংবা ঢাকায়। এটা খুঁজে পাওয়ার গল্প, এটা গানের গল্প নয়। একজন খুঁজে পায় বন্ধু, আরেকজন হয়তোবা ভাই। ব্যাকস্টেজে সিগারেট লেনদেন, তাড়াহুড়ো করে পরিচয়। টুকরো হাসি আর হ্যান্ডশেক, তার চেয়ে বেশি কিছু নয়। তবু মনে মনে সব বাধা পেরিয়ে, কত কিছু যায় ঘটে যায় মুখে তারা কিসসু না বললেও হৃদয়ে দাগ কেটে যায়। গান নিয়ে দুজনের কারবার, গানের জোরেই পরিচয়। গানের দৌলতে কাছে আসা, আর বাঁচার জন্য বিদায়। একজন ফিরে আসে দেশে, আরেকজন দেশে থেকে যায়। দুজনেই খুঁজে ফেরে রোজগার, কলকাতা কিংবা ঢাকায়। একজন ফিরে আসে দেশে, আরেকজন দেশে থেকে যায়। দুজনেরই হয়তো অজান্তে, কখনোবা কান্না পায়। একজন বাজায় গিটার, আরেকজন কীবোর্ডস। দুজনেই বেচে চলে গান, বাঁচার ইদুর দৌঁড়। দুজনেই হয়তোবা ভাবে আবার কোন জলসায়। গান হবে কাছে আসার জন্য, পয়সার জন্য নয়। একজন চায় বড় বেশি চায়, একজন হয়তোবা কম। একজন যদি হয় অঞ্জন, আরেকজন লাকী আখন্দ।


এই বিভাগের আরও