সরকারি অফিসের দুর্নীতিকে গোপন রাখার কৌশল?

৩০ জানুয়ারি ২০১৮, ১২:৩৬ পিএম | আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০২৪, ১২:২৪ এএম


সরকারি অফিসের দুর্নীতিকে গোপন রাখার কৌশল?
অনলাইন ডেস্ক [caption id="attachment_1607" align="alignnone" width="800"] ছবিঃ সংগৃহীত[/caption] ‘If liberty means anything at all, it means the right to tell people what they do not want to hear.’ ― George Orwell. অর্থাৎ স্বাধীনতার যদি কোনো মানে থাকে, তবে সেটা হলো মানুষ যা শুনতে চায় না, সেটা তাদের শোনানোর অধিকার। আমরা গণতন্ত্রের চর্চা করছি। কোথাও সফল, কোথাও অসফল। কিন্তু বাংলাদেশে একটি ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের ঘাটতি বিস্তর। সেটা হলো মতপ্রকাশের অধিকার। লেখক, সাংবাদিক, শিল্পী, চলচ্চিত্রকারদের স্বাধীনতা এ দেশে সীমিত। সীমিত রাজনৈতিক কারণে, ধর্মীয় কারণে, অসহিষ্ণুতার কারণে। কথাগুলো এ জন্য বললাম, কারণ তার একটি নতুন প্রেক্ষাপট রচিত হযেছে। সমালোচিত ৫৭ ধারাসহ কয়েকটি ধারা তথ্যপ্রযুক্তি আইন থেকে সরিয়ে সেগুলো আরো বিশদ আকারে যুক্ত করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের প্রস্তাবে চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে সরকার। সোমবার মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে এই আইন অনুমোদিত হয়। এ আইনে হ্যাকিং, ডিজিটাল মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে ‘অপপ্রচার’; রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিপন্ন করতে বা ভয়ভীতি সৃষ্টির জন্য কম্পিউটার বা ইন্টারনেট নেটওয়ার্কে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি এবং ডিজিটাল উপায়ে গুপ্তচরবৃত্তির মতো অপরাধে ১৪ বছরের কারাদণ্ডের পাশাপাশি কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে। আর ইন্টারনেটে কোনো প্রচার বা প্রকাশের মাধ্যমে ‘ধর্মীয় অনুভূতি বা মূল্যবোধে আঘাত’ করার শাস্তি হবে ১০ বছরের জেল, ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। আমরা এগোচ্ছি বলে দাবি করি। কিন্তু আইনটিতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের ঔপনিবেশিক আমলেরও পেছনে নিয়ে যাওযার উপাদান আছে। যেমন মানহানির জন্য ব্রিটিশরা আইন করেছিল দুই বছর কারাদণ্ডের, প্রস্তাবিত আইনে প্রথমবারের জন্য তিন বছর, দ্বিতীয়বারের জন্য পাঁচ বছর জেলের বিধান রাখা হয়েছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের জন্য ব্রিটিশরা জেল দিত দুই বছরের জন্য, প্রস্তাবিত এই আইনে ৭ থেকে ১০ বছর। গণমাধ্যমকর্মী ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তি ও সংগঠনের চাপে সরকার তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বেশ কয়েকটি ধারায় পরিবর্তন আনলেও নতুন যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করতে যাচ্ছে, তা নানাভাবে মতপ্রকাশকে সংকুচিত করার একটি আমলাতান্ত্রিক প্রচেষ্টা বৈ আর কিছু নয়। আগের আইনের ৫৭ ধারা যে কারণে সমালোচিত ছিল, সেভাবেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১৭, ১৯, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৬, ২৭, ২৮, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩ ও ৩৪ ধারাকে জামিন অযোগ্য অপরাধ হিসেবে দেখানো হয়েছে। অসৎ সরকারি কর্মচারী ও আমলারা এ আইন করে তাদের দুর্নীতি বিস্তার ও লোকচক্ষুর আড়ালে রাখার কৌশল করেছে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার কবর রচনা করবে প্রস্তাবিত এই আইন। এর ধারা ৩২-এ বলা হলো : যদি কোনো ব্যক্তি বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ কোনো সংস্থার গোপনীয় বা অতি গোপনীয় তথ্যউপাত্ত ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ করলে তা হবে ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির শামিল। আর এটি হবে অজামিন যোগ্য অপরাধ। এমন অপরাধের জন্য শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি প্রথমবার এই অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে অনূর্ধ্ব-১৪ বছরের কারাদণ্ড বা ২৫ লাখ টাকা জরিমানা, অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আর একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার বা বারবার ওই অপরাধে দোষী প্রমাণিত হলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত আফিসগুলোতে কী হয়, সবার জানা। এখন সব অনিয়ম আর দুর্নীতিকে জনগণের আড়ালে রাখতে এমন একটি বিধান ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে সাংবাদিকরা কার্যত সরকারি, আধা-সরকারি অফিসের ধারকাছে ঘেঁষতে পারবে না। সমস্যাটির বৃহত্তর সমাজতাত্ত্বিক প্রেক্ষিত নিয়ে কথা বলা দরকার। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পথে এটি একটি বড় বিপদ চিহ্নিত হয়ে থাকবে। দুঃখজনক যে জাতির পিতার কন্যাকে দিয়ে এমন একটি আইন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাকস্বাধীনতার নৈতিক এবং রাজনৈতিক গুরুত্ব সম্ভবত এখনকার আওয়ামী লীগের জন্য আলোচনার বিষয় নয়। একইভাবে কণ্ঠ চেপে ধরার চেষ্টা আছে সামাজিক মাধ্যমেরও। ধারা ১৭-তে বলা হয়েছে, কেউ যদি ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে জনগণকে ভয়ভীতি দেখায় অথবা রাষ্ট্রের ক্ষতি করে, তাহলে তা হবে অজামিনযোগ্য অপরাধ। এই অপরাধের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে, এই অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড অথবা এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ধারা ২৫-এ বলা হয়েছে, কেউ যদি ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল মাধ্যমে আক্রমণাত্মক ভয়-ভীতি দেখায় তাহলে তাকে তিন বছরের জেল বা তিন লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ধারা ২৬-এ বলা হয়েছে, আইনগত কর্তৃত্ব ছাড়া অন্য কারো পরিচিতি তথ্য সংগ্রহ, বিক্রি, সরবরাহ ও ব্যবহার করা হবে অপরাধ। তাহলে দেশে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে গবেষণার কাজ করবে কে? শুধু আইনগত কর্তৃত্ব আছে যাদের শুধু তারা? নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে কেউ রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা, নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করা বা জনগণের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি করলে বা করার চেষ্টা করলে অথবা ইলেকট্রনিক নেটওযার্ক ব্যবহার করে জনগণের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ ও সেবা ক্ষতিগ্রস্ত করলে তা হবে ডিজিটাল অপরাধ। এ ধারার অধীনে কোনো অপরাধীর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে, এ অপরাধে দোষী প্রমাণিত হলে তাকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা, নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব শব্দগুলো যেকোনো কর্তৃত্ববাদী মাসক বা ব্যক্তি যেকোনোভাবে ব্যাখ্যা করে মানুষকে হযরানি করতে পারবে। যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মীয় অনুভূতি বা মূল্যবোধে আঘাত করার জন্য ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ করে, তাহলে তাকে অনধিক ৭ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একই অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে তাকে অনধিক ১০ বছেরের কারাদণ্ড বা ২০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এটিও একটি এমন বিষয় যার যথেচ্ছ ব্যবহারের সুযোগ থাকবে এবং এটি বেশি করে করবে সাম্প্রদায়িক শক্তি। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার এ এক মোক্ষম অস্ত্র। যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায়, তাহলে তা ডিজিটাল অপরাধ। এই অপরাধের জন্য সাত বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এর যেকোনো ধরনের অপব্যাখ্যা হওয়ার সুযোগ থাকছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলে আসছিলেন, তথ্যপ্রযুক্তি আইন থেকে ৫৭ ধারা বাদ দিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে এ বিষয়ে ‘বিভ্রান্তি’ দূর করা হবে। এখন তথ্যপ্রযুক্তি আইন থেকে সরিয়ে ওই ধারার বিষয়বস্তু আরো বিশদ আকারে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সন্নিবেশ করা হলে তাতে অপব্যবহারের সুযোগ আরো বাড়বে বলেই আশঙ্কা করছি। নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দেওয়া রাষ্ট্রের কর্তব্য। আমরা স্বীকার করি যে, ‘অ-নিয়ন্ত্রিত বাক্‌স্বাধীনতা বিপজ্জনক হতে পারে কোন কোন ক্ষেত্রে। কোনো বক্তৃতা, বই, শিল্পকলা বা চলচ্চিত্র যদি বড় আকারের হিংসা, রক্তপাত বা নৈরাজ্যের সৃষ্টি করে এবং তার ফলে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বা স্থিতি বিপন্ন হয়, তবে হয়তো তার প্রচার বন্ধ বা নিয়ন্ত্রিত করতে পারে সরকার। কিন্তু কিছু করার আগেই গলা চেপে ধরার সংস্কৃতি রাষ্ট্রের প্রগতির জন্য বিপজ্জনক। অবস্থাটা এমন হয়েছে যে, সরকারি বা আধা-সরকারি অফিসের সামনে গিয়ে টেলিভিশন সাংবাদিক তার ক্যামেরা খুলতেই পারবে না কিংবা পত্রিকা বা অনলাইনের রিপোর্টার খুঁজবে শুধু ফুল, লতাপাতাবিষয়ক তথ্য।


এই বিভাগের আরও