জেনে নিন নরসিংদী জেলার শহীদ মিনার গুলোর ইতিকথা

০৭ মার্চ ২০১৮, ০৫:৪১ এএম | আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:০৬ পিএম


জেনে নিন নরসিংদী জেলার শহীদ মিনার গুলোর ইতিকথা
নিজেস্ব প্রতিবেদক [caption id="attachment_1901" align="alignnone" width="2676"] ছবিঃ সংগৃহীত[/caption] ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে করা মিছিলে কাঁদুনে গ্যাস ও গুলি চালানো হয়। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারীতেও প্রতিবাদ মিছিলে গুলি করা হয়। এতে শহীদ হন রফিক, সালাম, বরকত, আউয়াল, শফিউরসহ অনেকে। তাদের এই মহান আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধার প্রতীক কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার যা বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগ সংলগ্ন) অবস্থিত। এর স্থপতি হলেন হামিদুর রহমান। তবে এই শহীদ মিনারটি কিন্তু সর্বপ্রথম তৈরি হয়নি। বরং ক্রমানুযায়ী বিচার করতে গেলে এটির পূর্বে আরো কয়েকবার নির্মিত হয়েছিল শ্রদ্ধার পরিচায়ক এ স্মৃতিস্তম্ভ। প্রথম নির্মিত শহীদ মিনার ২১শে ফেব্রুয়ারির ঘটনার পর ২২শে ফেব্রুয়ারির প্রথম শহীদ মিনারটি বানানোর সিদ্ধান্ত হয়। কাজ শুরু হয় ২৩শে ফেব্রুয়ারি। কারফিউ থাকা সত্ত্বেও ২৩শে ফেব্রুয়ারি বিকেলে কাজ শুরু হয়। শহীদ মিনারটি তৈরি করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা। বদরুল আলম ও সাঈদ হায়দারের নকশায় বিকেল থেকে শুরু করে পুরো রাত কাজ করার পর শহীদ মিনারটি তৈরির কাজ শেষ হয়। এই কাজের তদারকি করেন জিএস শরফুদ্দিন ও সহযোগিতা করেন দুজন রাজমিস্ত্রী। নরসিংদী শহরের ব্রাহ্মন্দীতে অবস্থিত নরসিংদী সরকারি কলেজ শহীদ মিনারটি নরসিংদীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। নরসিংদীর কেন্দ্রীয় ও প্রথম এ শহীদ মিনারটি স্থাপিত হয় ১৯৬২ সালে। তৎকালীন রাজনৈতিক ও ছাত্র নেতৃবৃন্দের সহায়তায় নরসিংদী কলেজ কর্তৃপক্ষ এ শহীদ মিনার নির্মাণ করে। ১৯৬৪ সালে রাজনৈতিক ও ছাত্র নেতৃবৃন্দের সহায়তায় নরসিংদী শহরের ঐতিহ্যবাহী সাটির পাড়া স্কুল প্রাঙ্গণেও গড়ে উঠে আরো একটি শহীদ মিনার। ১৯৭২ সালে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলী নরসিংদী সরকারি কলেজের শহীদ মিনারটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের মত প্রায় সকল স্থানে একই আকৃতির শহীদ মিনার স্থাপিত হয়। নরসিংদী জেলায় মোট ৫৬৮টি শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছে। এরমধ্যে নরসিংদী সদরে ৯৮টি, রায়পুরায় ১০৭টি, বেলাবতে ৬৯টি, মনোহরদীতে ১০৯টি, শিবপুরে ১১৭টি ও পলাশে ৬৮টি শহীদ মিনার রয়েছে। নরসিংদী জেলার অধিকাংশ স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার রয়েছে। নরসিংদী সরকারি কলেজে জেলার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হলেও নরসিংদী জেলা স্টেডিয়াম সংলগ্ন স্থানে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ২০০৯ সালে অপর একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে। এ ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে নরসিংদীর আইডিয়াল হাই স্কুলে আরো একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে। এ নিয়ে জেলায় এ পর্যন্ত প্রায় ৬ শতাধিক শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে। তৎকালীন পাকিস্তান আমলে নরসিংদীর ন্যাপ নেতা মরহুম আবুল হাসিম মিয়া, আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম মুসলেহ উদ্দিন ভুঁইয়া, মরহুম মো. মতিউর রহমান, শিবপুরের মরহুম আব্দুল মান্নান ভুঁইয়া, মরহুম রবিউল আউয়াল খান কিরন, ফজলুর রহমান ফটিক মাস্টার, মনোহরদীর ভাষা সৈনিক মরহুম আব্দুস সাত্তার পন্ডিত, সাবেক এমপি মরহুম শহিদুল্লাহ ভুইয়া, আব্দুল আওয়াল শেখ, মরহুম সিরাজুল হক, মরহুম নাজিম উদ্দিন সরকার, মরহুম আব্দুল মান্নান বিটি, মরহুম হাফিজ উদ্দিন উকিল, মরহুম আব্দুল হেকিম, আব্দুল আউয়াল শেখ, বেলাব উপজেলার মরহুম কমরেট আব্দুল হাই, মরহুম সমসের আলী ভুঁইয়া, রায়পুরা উপজেলার মরহুম আফতাব উদ্দিন ভুঁইয়া, মরহুম ফজলুল হক খন্দকার, মরহুম সাদত আলী, পলাশ উপজেলার প্রয়াত বিজয় চ্যাটার্জি, মরহুম আহাম্মেদুল কবির প্রমুখ ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কমিউনিস্ট নেতা প্রয়াত অন্নদা পাল ও মরহুম ফয়েজ মাস্টার ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা ছিলেন। তৎকালীন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে তারাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কমিউনিস্ট নেতা জিতেন ঘোষ নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার রহিমাবাদে অবস্থান করে তাদের পার্টির কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। এখানে প্রয়াত ত্রৈলক্য নাথ চক্রবর্তী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মরহুম মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কমরেড আব্দুল হক, কমরেড তোহায়াসহ প্রখ্যাত রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা নিরাপদে থেকে তৎকালীন সময়ে তাদের পার্টির গোপন কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালে মহান ভাষা আন্দোলনের সৃষ্টি। মহান ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন নরসিংদীর শিবপুরের শহীদ আসাদুজ্জামান আসাদ। তিনিও এদেশের স্বাধিকার আন্দোলনে তৎকালীন ছাত্রসমাজের ৬ দফা ও ১১ দফা দাবি আন্দোলনের রাজপথের লড়াকু সৈনিক। আইয়ূব বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে ১৯৬৯ সনের ২০ জানুয়ারি ঢাকার রাজপথে পুলিশের গুলিতে তিনি নিহত হন। নরসিংদীর ঐতিহ্যবাহী সাটিরপাড়া কালী কুমার উচ্চ বিদ্যালয়, নরসিংদী সরকারি মহিলা কলেজ, ব্রাহ্মন্দী কে কে এম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, শিবপুর শহীদ আসাদ সরকারি কলেজ, রায়পুরা ডিগ্রী কলেজ, আদিয়াবাদ ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, বালুয়াকান্দী উচ্চ বিদ্যালয়, মনোহরদীর হাতিরদিয়া রাজি উদ্দিন কলেজ, এস আলী উচ্চ বিদ্যালয়, মনোহরদী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়, মনোহরদী গার্ল্স পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়, নরসিংদী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়, বেলাব হাই স্কুল, ঘোড়াশাল উচ্চ বিদ্যালয়, পলাশ শিল্পাঞ্চল কলেজ, মাধবদী কলেজ, আবদুল কাদির মোল্লা সিটি কলেজ, পাঁচদোনা স্যার কেজি গুপ্ত উচ্চ বিদ্যালয়সহ অন্য স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শহীদ মিনারে প্রতি বছর শহীদ দিবস উপলক্ষে নগ্ন পদে প্রভাত ফেরী, বুকে কালো ব্যাজ ধারণ করে পুষ্পাঞ্জলী প্রদান করে থাকে।