বাজেট প্রতিক্রিয়া: প্রস্তাবিত বাজেট তামাক নিয়ন্ত্রণের পরিপন্থী

২২ জুন ২০১৯, ০৭:৩০ পিএম | আপডেট: ২৮ মার্চ ২০২৪, ০১:২৫ পিএম


বাজেট প্রতিক্রিয়া: প্রস্তাবিত বাজেট তামাক নিয়ন্ত্রণের পরিপন্থী

সংবাদ বিজ্ঞপ্তি:

২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট তামাকবিরোধীদের হতাশ করেছে। বিশেষত বিড়ি এবং নিম্নস্তরে সিগারেটের দাম প্রায় অপরিবর্তিত রাখায় এগুলোর প্রকৃতমূল্য হ্রাস পাবে এবং ব্যবহার বাড়বে। অন্যদিকে, টানা তৃতীয় বছরের মতো সিগারেটের সম্পূরক শুল্ক প্রায় অপরিবর্তিত রাখায় তামাক কোম্পানিগুলো ব্যাপকভাবে লাভবান হবে।

সিগারেটের মূল্যস্তর সংখ্যা ৪টিতে অপরিবর্তিত রাখায় ভোক্তার স্তর পরিবর্তনের সুযোগ অব্যাহত থাকবে এবং তামাক কোম্পানি করফাঁকির সুযোগ পাবে।

এছাড়াও, অপ্রক্রিয়াজাত তামাকের রপ্তানি শুল্ক প্রত্যাহার এবং উপকরণ কর রেয়াত তামাক কোম্পানিকে ব্যাপকভাবে লাভবান করবে, সরকার হারাবে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব। তামাক চাষ উৎসাহিত হবে, খাদ্য নিরাপত্তা ও পরিবেশ হুমকির মুখে পড়বে। তবে, জর্দা-গুলের মত মারাত্মক ক্ষতিকর ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যের ট্যারিফ ভ্যালু প্রথা বিলুপ্ত করে খুচরা মূল্যের উপর করারোপ পদ্ধতি প্রচলন একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ।

 

আজ ২২ জুন ২০১৯, শনিবার, জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস্ এর সহায়তায় প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) ও অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া এলায়েন্স -আত্মা’র উদ্যোগে তামাকবিরোধী সংগঠন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন, এসিডি, ইপসা, বিটা, সুপ্র, এবং তামাকবিরোধী নারী জোট (তাবিনাজ) সম্মিলিতভাবে তামাক কর বিষয়ক বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে।

সংবাদ সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, চেয়ারম্যান, পিকেএসএফ ও চেয়ারম্যান, ন্যাশনাল এন্টি টোব্যাকো প্লাটফর্ম। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এর সাবেক চেয়ারম্যান ড. নাসির উদ্দিন আহমেদ।

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ এর প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব:) আব্দুল মালিক সভাপতিত্ব করেন।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন এটিএন বাংলার বার্তা সম্পাদক ও অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া এলায়েন্স- আত্মা’র কো-কনভেনর নাদিরা কিরণ। সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন মর্তুজা হায়দার লিটন, চিফ ক্রাইম করেসপন্ডেন্ট, বিডিনিউজ২৪.কম এবং কনভেনর, আত্মা; এম এ সালাম, গ্রান্টস ম্যানেজার, ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিড্স (সিটিএফকে), অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ এবং এবিএম জুবায়ের, নির্বাহী পরিচালক, প্রজ্ঞা। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রজ্ঞা’র কো-অর্ডিনেটর মো: হাসান শাহরিয়ার।

 

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে দেয়া বক্তব্যে অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে বিড়ি এবং নিম্নস্তরের সিগারেটের দাম প্রায় অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। জনগণের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় এসব পণ্য আরো সস্তা হয়ে যাবে। কার্যকর তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য তাই বিড়ি এবং নিম্নস্তরের সিগারেটসহ  সকল তামাকপণ্যের প্রকৃত মূল্য আরো বাড়িয়ে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যেতে হবে।

তিনি আরো বলেন, সিগারেটের শুল্ক না বাড়ানোর যে সিদ্ধান্ত সরকার নিতে যাচ্ছে বলে প্রস্তাবিত বাজেটে দেখা গেছে, তাতে তামাক কোম্পানির আয় ৩১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। সরকারের উচিত, তামাকপণ্যে সম্পুরক শুল্ক বাড়ানোর মাধ্যমে এ খাত থেকে নিজের রাজস্ব আয় বাড়ানো।

ড. নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে নিম্নস্তরে সিগারেটের দাম প্রায় অপরিবর্তিত থাকায় দামি স্তরগুলো থেকে বিশেষ করে মধ্যম এবং উচ্চস্তরের সিগারেট ভোক্তার একটি অংশ নিম্নস্তরে স্থানান্তরিত হওয়ার সুযোগ থেকে যাবে। ফলে মূল্যবৃদ্ধি হলেও তা সার্বিকভাবে সিগারেটের ব্যবহার হ্রাসে উল্লেখযোগ্য কোন প্রভাবই ফেলবে না। সিগারেটের মূল্যস্তর সংখ্যা কমিয়ে চার থেকে দুইয়ে নিয়ে আসার প্রস্তাবও দেন তিনি।

অনুষ্ঠানের সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব:) আব্দুল মালিক তাঁর বক্তব্যে বলেন, তামাক খাত থেকে যা আয় হয়, স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হয় তার তুলনায় অনেক বেশি। এ কারণেই কার্যকর তামাক নিয়ন্ত্রণ জরুরি।

 

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, তামাকবিরোধীদের পক্ষ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে সিগারেটের ৪টি মূল্যস্তরের পরিবর্তে দুইটি মূল্যস্তর প্রচলন এবং সম্পূরক শুল্ক এডভ্যালোরেম (মূল্যের শতকরা হার) পদ্ধতির পাশাপাশি একটি অংশ সুনির্দিষ্ট কর (স্পেসিফিক ট্যাক্স) হিসেবে আরোপ করার দাবি জানানো হলেও প্রস্তাবিত বাজেটে এর কোনো প্রতিফলন নেই। সিগারেটের মূল্যস্তর সংখ্যা অপরিবর্তিত রাখায় ভোক্তা তার সামর্থ্য অনুযায়ী ব্রান্ড বেছে নিতে পারবে, ফলে সিগারেটের ব্যবহার কমবে না। প্রস্তাবিত বাজেটে নিম্নস্তরের প্রতি শলাকা সিগারেটের মূল্য মাত্র ২০ পয়সা (৫.৭%) বৃদ্ধি করা হয়েছে, অথচ এসময়ে জনগণের মাথাপিছু আয় (নমিনাল) বেড়েছে ১১.৩২ শতাংশ। বর্তমানে সিগারেট বাজারের প্রায় ৭২ শতাংশই নিম্নস্তরের সিগারেটের দখলে রয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে সিগারেটের সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি না করায় তামাক কোম্পানিগুলো ব্যাপকভাবে লাভবান হবে এবং মূল্যস্তরভেদে তাদের আয় ৩১ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। প্রস্তাবিত বাজেটে ফিল্টারবিহীন ২৫ শলাকা বিড়ির মূল্য দুই বছর পর মাত্র ১.৫ টাকা বৃদ্ধি করে ১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এরফলে প্রতি শলাকা বিড়ির দাম বাড়বে মাত্র ৬ পয়সা। এই সামান্য মূল্যবৃদ্ধি বিড়ির ব্যবহার হ্রাসে কোনো প্রভাব ফেলবে না। প্রস্তাবিত বাজেটে ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যে ওজনের ভিত্তিতে খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দেয়ায়  এসব পণ্যের দাম কিছুটা হলেও বাড়বে এবং কর আদায়ের জটিলতা হ্রাস পাবে। করারোপের ক্ষেত্রে ট্যারিফ ভ্যালু পদ্ধতি পরিবর্তন করায় ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য থেকে বিগত বছরের তুলনায় সরকার প্রায় ২৬ শতাংশ বাড়তি রাজস্ব আয় করবে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ তামাক ব্যবহারকারী জনগোষ্ঠিকে জর্দা-গুল ব্যবহারের স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে রক্ষার ক্ষেত্রে মাননীয় অর্থমন্ত্রীর এই প্রয়াস নি:সন্দেহে প্রশংসনীয়। তবে, তামাক কোম্পানিকে মূল্য সংযোজন করের বিপরীতে উপকরণ কর রেয়াত গ্রহণের সুযোগ প্রদান এবং তামাক ও তামাকজাতপণ্য রপ্তানি উৎসাহিত করার অজুহাতে অপ্রক্রিয়াজাত তামাকের উপর আরোপিত ১০ শতাংশ রপ্তানি শুল্ক প্রত্যাহার এবং একটি নিন্দনীয় এবং চরম জনস্বাস্থ্যবিরোধী পদক্ষেপ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রক্রিয়াজাত তামাকপণ্যের রপ্তানি শুল্ক তুলে দেয়ার পর ২০১৬-১৭ এর তুলনায় ২০১৭-১৮ সালে তামাক ও তামাকজাত পণ্য রপ্তানি প্রায় ২১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং চলতি অর্থবছরের প্রথম দশ মাসেই আগের বছরের তুলনায় এখাতে রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ৮ লক্ষ ইউএস ডলার। সরকারের এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্তে তামাকচাষ বাড়তে থাকবে এবং খাদ্যনিরাপত্তা ও সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক পরিবেশ হুমকির মুখে পড়বে। একইসাথে তামাক রপ্তানি করে যে শুল্ক রাজস্ব আয় হতো, সরকার সেখান থেকেও বঞ্চিত হবে।

 

সংবাদ সম্মেলনে ২০১৯-২০ সালের চূড়ান্ত বাজেটে অন্তর্ভুক্তির জন্য নিম্নোক্ত প্রস্তাবসমূহ তুলে ধরা হয়:

  • নিম্নস্তরে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ৩৭ টাকার পরিবর্তে ৫০ টাকা নির্ধারণ করা;
  • নিম্নস্তরের সিগারেটের উপর বিদ্যমান ৫৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্কের পরিবর্তে ৬০ শতাংশ এবং মধ্যম, উচ্চ ও প্রিমিয়াম স্তরে বিদ্যমান ৬৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্কের পরিবর্তে ৭০ শতাংশ নির্ধারণ করা। প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটে ৫ টাকা সুনির্দিষ্ট কর আরোপ করা; সিগারেটের মূল্যস্তর সংখ্যা চারটি থেকে কমিয়ে দুইটিতে নিয়ে আসা;
  • বিড়ির ফিল্টার- ননফিল্টার মূল্যবিভাজন তুলে দিয়ে ২৫ শলাকা বিড়ির খুচরা মূল্য ৩৫ টাকা নির্ধারণ এবং ৪৫% সম্পূরক শুল্ক ও ৬ টাকা সুনির্দিষ্ট কর আরোপ করা;
  • প্রতি ১০ গ্রাম জর্দার খুচরা মূল্য ৩৫ টাকা এবং প্রতি ১০ গ্রাম গুলের খুচরা মূল্য ২০ টাকা নির্ধারণ করা; ১০ গ্রাম জর্দা ও গুলের উপর যথাক্রমে ৫ টাকা এবং ৩ টাকা সুনির্দিষ্ট কর আরোপ করা;
  • অপ্রক্রিয়াজাত তামাকের ওপর বিদ্যমান ১০ শতাংশ রপ্তানি শুল্ক বহাল এবং প্রক্রিয়াজাত তামাকপণ্যের ওপর পুনরায় ২৫ শতাংশ রপ্তানি শুল্ক আরোপ করা;
  • জনস্বার্থে তামাক কোম্পানিগুলোর উপকরণ কর রেয়াত গ্রহণ সুযোগ বাতিল করতে বিদ্যমান মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২ এর ৪৬ ধারার অন্তর্গত উপধারা ৩ এর দফা ঙ পুনর্বহাল করা, যেখানে তামাক ও এলকোহলযুক্ত পণ্যের ক্ষেত্রে এধরনের সুযোগ গ্রহণ রহিত করা হয়েছে;
  • সকল প্রকার ই-সিগারেট এবং হিটেড (আইকিউওএস) তামাকপণ্যের উৎপাদন, আমদানি এবং বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করা।

বিভাগ : অর্থনীতি


এই বিভাগের আরও