নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ঠেকানোই এখন এনবিআরের বড় চ্যালেঞ্জ

০৬ জুন ২০২০, ১১:৫১ পিএম | আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:৩৩ এএম


নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ঠেকানোই এখন এনবিআরের বড় চ্যালেঞ্জ

অর্থনীতি ডেস্ক:

২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) শুল্ক-কর আদায়ে ঘাটতি ৬২ হাজার কোটি টাকা। বছর শেষে সংশোধিত লক্ষ্য থেকেই ঘাটতি ৮০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মনে করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। অন্যদিকে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি মনে করছে, এবারের ঘাটতি ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

প্রতি বছরেই রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি থেকে যায়। আর এ বছর করোনা ভাইরাসের অভিঘাতে সেই ঘাটতি আরও বেড়ে যাবে, সেটাই স্বাভাবিক। শেষ পর্যন্ত ঘাটতি কতটা কমানো যাবে, সেটাই এখন প্রশ্ন। আর রাজস্ব আদায়ে এই নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ঠেকানোই এখন এনবিআরের বড় চ্যালেঞ্জ। আবার আসছে নতুন বাজেট। একদিকে করোনার অভিঘাতে আগামী অর্থবছরে নতুন করারোপের চেয়ে বেশি কর ছাড় দেওয়ার চাপ, অন্যদিকে বাড়াতে হবে আদায়। এর মধ্যেই আগামী ১১ জুন ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট দিতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল।

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকায় গত এপ্রিল মাসে যে রাজস্ব আদায় হয়েছে, তা চলতি অর্থবছরের অন্য যেকোনো মাসের তুলনায় প্রায় অর্ধেক। এর মধ্যে বছরের প্রধান দুটি উৎসব চলে গেছে বাংলা নববর্ষ ও ঈদ। এই দুই উৎসবে সরকার বিপুল পরিমাণ ভ্যাট পেয়ে থাকে। কিন্তু এবার সেই সংগ্রহ অনেক কম। তাই এনবিআরের পূর্বাভাস অনুযায়ী, এবার বড়জোর ২ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার মতো শুল্ক-কর আদায় হতে পারে।

করোনা ভাইরাসের অভিঘাতে আগামী অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) ব্যবসা-বাণিজ্য সেরকম চাঙা থাকবে বলে কেউই মনে করছেন না। লকডাউন তোলার পর মানুষ ব্যক্তিগত ব্যয়ের ক্ষেত্রে অনেক সাবধানী থাকবে। এতে ভ্যাট আদায় কমে যাবে। তা সত্ত্বেও আগামী অর্থবছরে এনবিআরকে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের বিশাল লক্ষ্য দেওয়া হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে আগামী অর্থবছরে ৫০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। প্রতি বছর রাজস্ব আদায়ে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়। গত ১০ বছরে মাত্র একবার ২০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

চূড়ান্ত সংক্রমণের সময় সব খুলে দেওয়া হলেও অর্থনীতি স্বাভাবিক গতিতে চলছে না বলেই জানা গেছে। বাংলাদেশ বিমান যাত্রী না পেয়ে উড়ান বাতিল করছে। ঈদের আগে শপিং মল খুলে দেওয়া হলেও মানুষ সেভাবে শপিং করেনি বলেই জানা গেছে। বিশ্লেষকেরা বলেন, কর্মী ছাঁটাই, বেতন-বোনাস কর্তন এসব কারণে মানুষের আয় কমে গেছে। আর আয় না থাকলে মানুষ ব্যয় করবেই বা কীভাবে।

মে মাসের হিসাব এখনো চূড়ান্ত হয়নি। গত এপ্রিলে ১৯ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল। হয়েছে মাত্র ৮ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। সার্বিকভাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৭৯৬ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে। এই সময়ে শুল্ক-কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৩৫ হাজার ৭৯৫ কোটি টাকা। ঘাটতি প্রায় ৬২ হাজার কোটি টাকা টাকা।

রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির জন্য নতুন ভ্যাট আইন চালু করা হয়। কিন্তু সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির কারণে সবকিছু বন্ধ থাকায় এপ্রিল মাসে অর্ধেক প্রতিষ্ঠানই রিটার্ন জমা দিতে পারেনি। চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস হলো রাজস্ব আদায়ের সবচেয়ে বড় জায়গা। কিন্তু সীমিত পরিসরে আমদানি চালু থাকায় গত এপ্রিল মাসে চট্টগ্রাম বন্দরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার এক-তৃতীয়াংশ অর্জিত হয়েছে।

চলতি অর্থবছরে এনবিআরের মূল লক্ষ্য ছিল ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। কাক্সিক্ষত হারে রাজস্ব আদায় না হওয়ায় এই লক্ষ্য কমিয়ে ৩ লাখ ৫০০ কোটি টাকা করা হয়েছে। সেই হিসাবে মে ও জুন মাসে এনবিআরকে ১ লাখ ২৬ হাজার ৭০ কোটি টাকা আদায় করতে হবে। করোনার সময়ে এই লক্ষ্য অর্জন প্রায় অসম্ভবই বলা চলে।

এই অসম্ভব বিষয়টি ইতিমধ্যে অর্থসচিবকে জানিয়ে দিয়েছেন এনবিআরের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। গত ১৪ মে দেওয়া এক চিঠিতে তিনি আরও বলেছেন, আগামী অর্থবছরে যে লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে, তা আদায় করাও সম্ভব হবে না।

সার্বিকভাবে এনবিআরকে লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় করতে হবে ভ্যাটে। এই খাতে ১ লাখ ২৮ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা আদায় করার লক্ষ্য দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া আয়করে ১ লাখ ৫ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা এবং শুল্ক খাতে ৯৫ হাজার ৬৫২ কোটি টাকার লক্ষ্য থাকছে।

রাজস্ব আদায় বাড়াতে গত জুলাই মাস থেকে নতুন ভ্যাট আইন চালু হয়। উদ্দেশ্য, রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি। মাঠপর্যায়ে নতুন আইনের নানা জটিলতার কারণে প্রথম দুই মাস ভ্যাট আদায়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়। আর প্রথম ছয় মাসে ভ্যাট আদায়ে প্রবৃদ্ধি হয় মাত্র ৭ শতাংশ। অন্য বছর এই সময়ে ভ্যাটের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের বেশি থাকে।

আইনটি বাস্তবায়নের শুরু থেকেই মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন সমস্যা হয়। ব্যবসায়ীরা নতুন আইনে অভ্যস্ত হতে পারেননি। এবারই প্রথম কিছু বাদ দিয়ে আমদানি পর্যায়ে সব ধরনের পণ্য ও সেবায় আগাম ভ্যাট বসানো হয়। পরে আবার প্রজ্ঞাপন দিয়ে আগাম ভ্যাট ছাড়ের পণ্যের তালিকা বাড়ানো হয়।

আগাম কর ফেরত দেওয়া নিয়েও তৈরি হয় নানা জটিলতা। আগাম কর ফেরত দেওয়ার কোনো আলাদা তহবিল তৈরি করা হয়নি। নতুন আইন চালুর প্রায় ৬ মাস পর বলা হয়, এনবিআরের পরিচালন খরচ থেকে আগাম কর ফেরত দেওয়া যাবে।

নতুন ভ্যাট আইনে বেচাকেনার হিসাব রাখার জন্য ২৪ ধরনের ব্যবসায় স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি বা ইএফডি মেশিন ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক করা হয়। এতে ছোট ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়েন। তাঁদের দাবি, স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে হিসাব করতে হলে আলাদা লোকবল লাগবে। এ ছাড়া গত জুলাই মাসে কেনা দামে ছোট ব্যবসায়ীদের ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) মেশিন দেওয়ার কথা থাকলেও এখনো তা সম্ভব হয়নি। চলতি জুন মাস থেকে পরীক্ষামূলকভাবে ইএফডি মেশিনের ব্যবহার শুরু হবে।

নতুন আইনে অটোমেশনে জোর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু একমাত্র যশোর ভ্যাট কমিশনারেট ছাড়া আর কোথাও ঘরে বসে সবার ভ্যাট রিটার্ন জমা নিশ্চিত করা যায়নি। ফলে করোনার সময় নিয়মিতভাবে যেসব প্রতিষ্ঠান ভ্যাট রিটার্ন দেয়, তাদের অর্ধেকের বেশি প্রতিষ্ঠান রিটার্ন দেয়নি।


বিভাগ : অর্থনীতি


এই বিভাগের আরও