একটি নতুন ভোরের প্রত্যাশা: মহসিন খোন্দকার

০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৭:১২ পিএম | আপডেট: ২৭ মার্চ ২০২৪, ০৪:০২ এএম


একটি নতুন ভোরের প্রত্যাশা: মহসিন খোন্দকার

সাফল্যের শেষ নেই, শেষ আছে ব্যর্থতার। বাংলাদেশ বুক লেংচাতে লেংচাতে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পথটা খুবই শ্বাপদসংকূল, কন্টকাকীর্ণ। তাই স্বদেশের দেহ ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে আর রক্ত ঝরছে। এগিয়ে যাওয়ার পথে অনেক বাঁধা। পিছনে টানছে একাত্তরের পরাজিত শক্তি, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, জঙ্গিবাদ, মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ ও নব্য ফ্যাসিবাদ। বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে রক্তকমলের কোষ কলা থেকে, বিপ্লবের বহ্নি শিখা থেকে। এই দেশ জন্মের সূচনা লগ্নেই তার ভাষা কেড়ে নেওয়ার ঘৃন্য ষড়যন্ত্রের দাঁত ভাঙ্গা জবাব দিয়েছে। তাপর এক রক্তাক্ত পরিসমাপ্তি শেষে ভাষা বীরেরা দেখেছে স্বাধীনতার গিরি চূড়া ও আলোর উৎসারণ। ১৯৬২ সালের বৈষম্যমূলক শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তুলেছিল এ দেশের ছাত্র- যুবকরা। সেটির ইতিবাচক পরসমাপ্তি হলে পূর্ব পাকিস্তানের সাহসী নেতাদের শৃঙ্খলিত ও আন্দোলনের লাগাম টেনে ধরার জন্য তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। সে মিথ্যা মামলা ও গ্রেফতারের প্রতিবাদে সারা বাংলায় ১৯৬৯ সালে গণজোয়ার সৃষ্টি হলে, প্রতিবাদের ঝড় উঠলে, পাক-শাসকরা বিনা শর্তে শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

১৯৭০ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও পাক-শাসকদের গভীর ষড়যন্ত্র ও কূটচালের কারণে পূর্ব-পাকিস্তানের নির্বাচিত নেতারা ক্ষমতায় বসতে পারেননি। সে অন্যায়ের আগুন ঘনীভূত হতে হতে রুপ নেয়- মহান মুক্তিযুদ্ধে। আমাদের স্বাধীনতার মহান স্থপতি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ দেশের এক ক্রান্তিলগ্নে তৎকলীন রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার সামনে এক ঐতিহাসিক ভাষণে জাতিকে দিক নির্দেশনা দেন। তারপর ১৯৭১ সালে অনেক ক্ষয়-ক্ষতি স্বীকার করে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় আসে।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী স্বধীনতার মহান স্থপতি বীরের মতো স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন- দেশ পরিচালনায় হাত দেন। কিন্তু বাঁধ সাধে মৃত সাপের বিষ, সিআইএর গভীর ষড়যন্ত্র , একদল উচ্চ বিলাসী সেনা কর্মকর্তা ও দেশ- বিদেশী নানা ষড়যন্ত্র। ষড়যন্ত্রকারীরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট মহান স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে ইতিহাসের এক কলঙ্ক জনক অধ্যায় রচনা করেন। এই চরম ঘৃন্য ঘটনার পর দেশ এক গভীর অন্ধকারে নিপতিত হয়, স্বদেশ চলতে থাকে উদ্ভট উটের পীঠে।

৭৫ পরবর্তী শাসকরা সিংহাসনে বসে বঙ্গবন্ধুর খুনীদেরকে শুধু পুরস্কৃতই করেননি, তাদেরকে বাঁচাতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশও জারি করেন। তারপর স্বাধীন দেশের পবিত্র মাটিতে প্রত্যাবর্তন করে একাত্তরে পালিয়ে যাওয়া ঘাতক, দালাল, রাজাকার, কুখ্যাত বদর বাহিনীর লোকেরা। তাদের জটিল কুটিল বিশ্রি হাসির অন্তরালে চাপা পড়ে যায় স্বাধীন দেশের সকল অর্জন। তারপর বাংলাদেশ অন্ধকারের চোরাগলিতে হাঁটে দীর্ঘ একুশ বছর। এই দীর্ঘ সময়ে এ দেশের মানুষ সহ্য করেছে স্বৈরাচারের নির্লজ্জ নৈরাজ্য, দুঃশাসনের দুর্বিসহ যন্ত্রণা। ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে স্বৈরাচার হটিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় এলেও আত্ম-কোন্দল, অদক্ষতা, দলীয়করণের কারণে দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারেনি।

১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এসেও তেমন কোনো উন্নতি করতে পারেনি দেশ ও মানুষের। ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির নেতৃতাধীন চার দলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় এসে সারা দেশে অগ্নি সন্ত্রাস, খুন, লুট, হত্যা, গণধর্ষণ ও ব্যাপক সংখ্যালঘু নির্যাতন চালিয়ে দেশকে এক কয়েদখানায় পরিণত করে। এই সময় সারা দেশে মাথা চাড়া দিয়ে উঠে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন। জঙ্গিরা উত্তর ও দক্ষিন বঙ্গে বোমা হামলা চালিয়ে, প্রকাশ্যে জবাই করে মানুষ হত্যা করে ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি করে। জঙ্গিরা সারা বাংলাদেশের ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা হামলা চালায়। তারপর সর্বশেষ ভয়াবহ ঘটনাটি ঘটে ২০০৪ সালের ২১ শে আগষ্ট। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করার লক্ষে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালায় বঙ্গবন্ধু এভিন্যুর আওয়ামীলীগের জনসভায়। শেখ হাসিনা অল্পের জন্য প্রানে বেঁচে গেলেও সে গ্রেনেড হামলায় আইভি রহমানসহ ২৪ জন প্রাণ হারান। অনেক রাজনৈতিক ঝড়-ঝঞ্ঝার পর দেশ পরিচালনার ভার নেন তত্বাবধায়ক সরকার। তত্বাবধায়কের আমলে, সবচেয়ে আলোচিত সমালোচিত ঘটনা হলো ক্লিন হার্ট অপারেশনের নামে একের পর এক বিচার বর্হিভূত হত্যাকান্ড ।

২০০৮ সালের শেষে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ আবার ক্ষমতায় আসে। ২০০৯ সালের শুরুতে তারা দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে এখনো তা চলমান আছে। এই দশ বছরে তারা সারা দেশে অনেক দৃশ্যমান উন্নয়ন করেছে। এসবের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য নতুন নতুন ফ্লাইওভার নির্মাণ, ঢাকা- চট্রগ্রাম ডবল রেলপথ নির্মাণ, চট্রগ্রামে অনেক গুলো ফ্লাইওভার নির্মাণ, শিক্ষাখাতে ব্যাপক উন্নয়ন, চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন, জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন, বহু রকমের ভাতা চালু করা, বিদ্যুৎ খাতের ব্যাপক উন্নয়ন, কৃষকদের সার-কীটনাশকের নিশ্চয়তা প্রদান, ব্যাপক কর্মসংস্থান, আইটি সেক্টরে অভূতপূর্ব সাফল্য, সমুদ্র সীমার জয়লাভ, ছিটমহল দ্বন্দ্বের সমাধান, পার্বত্য শান্তি চুক্তি ও নিরস্ত্রীকরণ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসি দেওয়া, নিজস্ব স্যাটালাইট স্থাপন, পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালুর উদ্যোগ ও নতুন পদ্মা মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে এই সরকার। তবে ২০১০ সালের পর ভয়াবহ কয়েকটি মানবিক বিপর্যয়ের ঘটনাও ঘটেছে। সাভারে রানা প্লাজা ধসে প্রায় ১২ শত নিরিহ গার্মেন্টস শ্রমিকের প্রাণ যায়, তাজরীন ফ্যাশনে আগুন লেগে ১১১ জন গামের্ন্টস শ্রমিক অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান।

বাংলার ইতিহাসে আরো একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়ের রচিত হয়েছিল ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানার বিডিআরের সদরদপ্তরে। ইতিহাসে এটি বিডিআর বিদ্রোহ নামে খ্যাত। সেই বিদ্রোহে বিডিআরের মহাপরিচালক শাকিল আহমেদ সহ প্রাণ হারান ৫৬ জন আর্মি অফিসার এবং আরো অন্যান্য ১৭ সহ মোট ৭৩ জন। ২০১৪ সালে জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সারাদেশ খুব অশান্ত হয়ে উঠে, সারাদেশে চলতে থাকে রাজনৈতিক সহিংসতা। হামলা মামলা জ্বালাও পোড়াও , সংখ্যালঘু নির্যাতন, হরতাল, অবরোধ, ভাংচুর ও পিটিয়ে পুলিশ হত্যার মতো ঘটনাও ঘটেছে তখন। এসবের এক পর্যায়ে হেফাজতের শাপলা চত্বরে অবস্থান, আন্দোলন ও নৈরাজ্য, সারা দেশে আইন শৃঙ্খলার ব্যাপক অবনতি ও আগুন সন্ত্রাসের কারণে ঝরেছিল অনেক প্রাণ। ২০১৬ সালের ১ জুলাই ঢাকার গুলশানের হলিআর্টিসানে জঙ্গি হামলায় ১৭ জন বিদেশীসহ নিহত হন ২০ জন। এটি আমাদের অস্তিত্বের ভীতকে খুব কাঁপিয়ে দেয়। তবু এসব থোকা থোকা আঁধার পেরিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার।

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট বিশাল জয়লাভ করলে আবারও দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পায় তারা। ২০১৯ সালের উষালগ্নে এসে বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখছে খুলে যাবে তার দক্ষিন দুয়ার (পদ্মা সেতু), ঢাকায় চালু হবে এক্সপ্রেস এলিভেটেট ট্রেন, চালু হবে রুপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, চালু হবে ই-এডুকেশন, বাড়বে জীবনযাত্রার মান। তারপরও স্বদেশের হৃৎপিন্ডের ভেতর থেকে জটিল রোগ সারাতে না পারলে, সামনে কঠিন সমস্যায় পড়বে এ জাতি। এসবের মধ্যে লাগামহীন দুর্নীতি, ব্যাপক দলীয়করণ, লুটপাট, জবরদখল, উন্নয়নের নামে সম্পদ ভাগাভাগি, রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতাসহ অতি আমলা নির্ভরতা কমাতে হবে বর্তমান সরকারের। আমরা স্বপ্ন দেখি ঘুষ দুর্নীতি মুক্ত, দালাল মুক্ত, দলীয়করণ মুক্ত একটি সুখী সমৃদ্ধ আধুনিক বাংলাদেশ। যেখানে বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদবে না, যেখানে নেশার জন্য গুলিবিদ্ধ হবে না যুবক, যেখানে অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসার জন্যে ধুকে মরবে না কেউ। একটি নতুন সম্ভাবনা, একটি নতুন সময়ের দিকে এগিয়ে যাক এ সাহসী জাতি। একটি নতুন ভোরের প্রত্যাশায় একুশ শতকের আলোকিত আঙ্গিনায় প্রবল আগ্রহে বসে আছি আমরা।

লেখক পরিচতি- কবি ও লেখক

 


বিভাগ : মতামত


এই বিভাগের আরও