ধান তথা কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার কারণ

১৭ জুন ২০১৯, ০৪:৫৩ পিএম | আপডেট: ২৭ মার্চ ২০২৪, ০৪:০২ এএম


ধান তথা কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার কারণ
Narsingditimes.com

মোশাররফ হোসেন

দেশের অর্থনীতিকে মজবুত রাখতে কৃষক এবং কৃষি মন্ত্রণালয়কে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা “এক ইঞ্চি জমিও পতিত রাখা যাবে না”।
নির্দেশনা দেয়ার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর কিছু চিন্তা চেতনা ছিল। যেমন গত বছর বোরো ধান উৎপাদন ও সংগ্রহ আগাম ও অসময়ের বন্যা, হাওড় এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙ্গে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হওয়া এবং বিক্ষিপ্তভাবে আবহাওয়ার বৈরিতার জন্য ঝড়, শিলাবৃষ্টিতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি। ফলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ছিল সময়োপযোগী ও যৌক্তিক।
উক্ত নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের সকল বিভাগ ও দপ্তর সমূহের সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা/কর্মচারীগণ নিরলস পরিশ্রম করেন। বিশেষ করে মাঠ পর্যায়ে কর্মরত (উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা) কৃষি কর্মীগণ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত নতুন নতুন জাত এবং উচ্চ ফলনশীল জাতের আবাদ বৃদ্ধির জন্য কৃষকদের উদ্ধুদ্ধ করেন এবং পরামর্শ প্রদান করেন।
বীজ সংগ্রহ থেকে শুরু করে বীজতলায় চারা উৎপাদন, সঠিক সময়ে চারা রোপন, সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ, সঠিক পরিচর্যাসহ সর্বোচ্চ ফলন প্রাপ্তির জন্য প্রযুক্তিগত পরামর্শ ও সেবা প্রদানের মাধ্যমে ফসল সংগ্রহ পর্যন্ত কৃষকের পাশে ছিলো কৃষি বিভাগ।
সরকারের পক্ষ থেকে আবাদ বৃদ্ধির জন্য প্রণোদনা কর্মসূচীর মাধ্যমে কৃষকদের বীজ ও সার সরবরাহ করে উৎসাহ প্রদান করা হয়। ফলে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়। অপরদিকে চলতি মৌসুমে ধান উৎপাদনের জন্য আবহাওয়া ছিল অরেকটাই অনুকূলে। বিশেষ করে ধান গাছে কাইচ থোর আসার পর হতে (চৈত্র মাসে) নিয়মিত বিরতিতে বৃষ্টিপাত হওয়ায় ধানের উৎপাদনও হয়েছে অন্য যেকোন মৌসুমের চেয়ে অনেক বেশি। কোন কোন নতুন জাতের ফলন কৃষি বিজ্ঞানীদের অবাক করে দিয়ে গবেষণা মাঠের চেয়ে অধিক ফলন পাওয়া গেছে।

ধান কর্তন শুরু হওয়ার পর আবহাওয়ার আচরণ ছিল কৃষকের জন্য আরো একটি বিশেষ নেয়ামত। গত মৌসুমে বৈশাখ ও জৈষ্ঠ্য মাস পর্যন্ত যে পরিমান বৃষ্টিপাত হয়েছে, চলতি সময়ে তার বিপরীত অর্থাৎ বৃষ্টিপাতের পরিমাণ খুবই কম। ফলে কৃষক নিরাপদে ধান সংগ্রহ করার বিশাল সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু ধান কর্তনের জন্য পর্যাপ্ত শ্রমিক না থাকায় শ্রমিক বাবদ খরচ বেশি পড়েছে। তারপরও কৃষক ধান সংগ্রহ করে ঘরে তুলেছেন।
সরকার মৌসুম ভেদে প্রতি বছরই কৃষকের নিকট হতে দানা শস্য হিসেবে ধান, চাল, গম, সংগ্রহ করে থাকে। কিন্তু উক্ত সংগ্রহ কার্যক্রমে নীতিনির্ধারক পর্যায়ের কিছু জটিলতার জন্য সঠিক সময়ে সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু করা যায় না। ফলে কৃষক ন্যায্যমূল্য হতে বঞ্চিত হয়। এ সুযোগে মধ্যসত্বভোগী দালাল ফড়িয়ারা সরকারি সকল সুবিধা অর্থাৎ ধানের সঠিক মূল্য পেয়ে থাকে। চলতি মৌসুমেও এর ব্যতিক্রম কিছু ঘটে নাই।
এদেশের বেশিরভাগ কৃষকই ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক শ্রেণির এবং হাওড় এলাকার ৮০ ভাগ কৃষকই ভূমিহীন। ফলে কৃষকগণ এলাকার দাদন ব্যবসায়ীর নিকট থেকে উচ্চ সুদে ঋণ গ্রহণ করে বোরো ধানের চাষ করে থাকেন। কিন্তু চাষাবাদ শেষ হওয়ার পর ধান কর্তন শুরু হওয়ার সময় চাষীর নিকট তেমন একটা টাকা পয়সা থাকে না। এসময়টাতে একদিকে দাদন ব্যবসায়ীর টাকা পরিশোধের চিন্তা অপরদিকে কৃষি শ্রমিক মজুরি ব্যয় নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন কৃষক। এর ফলে ধান কাটার সাথে সাথেই কৃষক বাধ্য হয়ে ধান বিক্রির জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এ সুযোগে মধ্যসত্ব ফড়িয়া ও দাদন ব্যবসায়ীগণ নামমাত্র মূল্যে ভূমিহীন ও ক্ষুদ্র প্রাান্তিক কৃষক এর নিকট হতে ধান কিনে মজুদ করে থাকে। আর এতে কৃষক ধানের ন্যায্যমূল্য হতে বঞ্চিত হয়।

আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসন করে সরকারি পর্যায়ে যখন ধান, চাল সংগ্রহ শুরু করা হয় তখন কৃষকের নিকট বিক্রয়যোগ্য অবশিষ্ট বলতে কিছুই থাকে না। এ সুযোগে মধ্যসত্বভোগী, দালাল, ফড়িয়া বা দাদন ব্যবসায়ীর নিকট হতে ধান চাল সংগ্রহ করে থাকেন। প্রকৃত পক্ষে কৃষকের জন্য কেউ কিছুই ভাবেন না বা করেন না। বরং কৃষকদের নিয়ে তামাশা করার জন্য লোকের অভাব হয় না। এইতো কৃষক তার উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্যের জন্য ধানের জমিতে আগুন দিলো, রাস্তায় ফেলে প্রতিবাদ করলো তখন এদেশের নীতি নির্ধারক, পুঁজিবাজ এবং সুরক্ষা বিভাগসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ ও সংগঠন সমূহ নির্বোধের মত কৃষকদের নিয়ে তামাশা করতে দেখা গেল। কৃষকদের সমস্যা সমাধান না করে তাদের কে নিয়ে যথারীতি ছেলে খেলা হয়েছে বলেই মনে হলো।
একজন জেলা প্রশাসক কৃষকের ধান কাটতে গেলেন। প্রশ্ন হচ্ছে কৃষক শ্রমিকের জন্য হাহাকার করেছিলেন কি? না কি উৎপাদিত ধানের সঠিক মূল্যের জন্য আর্তনাদ করেছেন। যদি শ্রমিকের জন্য হাহাকার করে থাকেন, তাহলে একজন শ্রমিকের মজুরি যেখানে ৬০০-৮০০ টাকা সেখানে একজন জেলা প্রশাসকের একদিনের বেতন ভাতা ৩২০০-৩৫০০ টাকা। জেলা প্রশাসক ধান কাটতে গিয়ে উৎপাদন খরচ কমাতে চেয়েছেন অথবা শ্রম মূল্য কমাতে চেয়েছিলেন কী না সাধারণভাবে প্রশ্ন উঠতেই পারে।
একজন ব্যাংক কর্মকর্তা একদিনের বেতন ভাতা বাদ দিয়ে দুপুরের লাঞ্চ বাবদ যে ভাতা গ্রহণ করেন, সে টাকায় দু’জন কৃষি শ্রমিকের ৩ বেলা খাবার দেয়া সম্ভব। আর ব্যাংক কর্মকর্তার ধান কাটার উদ্দেশ্যে উৎপাদন খরচ বাড়ানোর চেয়ে খেলাপি ঋণগ্রহণে মনোযোগী হলে এবং কৃষকদের ঋণ প্রদান করলে দেশের অর্থনীতির চাকা আরও টেকসই হত বলে মনে করাটাই স্বাভাবিক।
পুলিশ সুরক্ষার দায়িত্বের পরিবর্তে কৃষকের কাচা ধান কাটার যে মহোৎসব দেখালো তাতে পুলিশের প্রকৃত দায়িত্ববোধের যে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে তাহা দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেখলেই বুঝা যায়। অথচ পুলিশ বা কর্মকর্তারা যদি ধান কাটার পরিবর্তে দালাল, ফড়িয়া, দাদন ব্যবসায়ী তথা মধ্যসত্বভোগী রোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতো তাহলে কৃষক উপকৃত হতো।
উক্ত তামাশার বিবরণী হতে প্রশ্ন আসতেই পারে আমরা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে কতটা আন্তরিক এবং আমরা কী আসলেই দেশপ্রেমিক?


বিভাগ : মতামত


এই বিভাগের আরও