মো: জালাল উদ্দিন: এক বিরলপ্রজ নাট্যকার

১২ জানুয়ারি ২০২০, ০৭:২৫ পিএম | আপডেট: ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৫:৪৭ পিএম


মো: জালাল উদ্দিন: এক বিরলপ্রজ নাট্যকার

                    ---মহসিন খোন্দকার---

আমরা দেখি শেক্সপিরিয়ান নাটকে একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে অতিপ্রাকৃত উপাদান ও অনুসঙ্গ। গ্রিক নাটকে দেব-দেবীর প্রভাবও পূর্বনির্ধারিত ভাগ্য বা নিয়তি পরিলক্ষিত হয় প্রবল ভাবে। জর্জ বানার্ড'শ এর নাটকে দেখি যুদ্ধ, রাজনীতি ও ধর্মদ্বন্দ্বের প্রবল প্রভাব, তবে আইরিশ এই নাট্যকার নরজিয়ান নাট্যকার হেনরিক ইবসেন দ্বারা বেশ প্রভাবিত হয়েছিলেন। আমেরিকার নাট্যকার ইউজিন তার নাটকে তুলে ধরেছেন মোহ ও নৈরাশ্য কাটিয়ে উঠার সংগ্রাম, আশা আকাঙ্খা পূরণের সংগ্রাম। স্যামুয়েল বাকেটে'র নাটকে দেখি হাস্যরস, মানসিক উৎকন্ঠা, মনোজাগতিক সংকট। আর আধুনিক নাটকের জনক নরজিয়ান নাট্যকার হেনরিক ইবসেন তিনি তার নাটকে তুলে ধরেছেন বাস্তববাদ, সামাজিক মূল্যবোধ, বিশ্বাস ও বিচার।

তবে এই উপমহাদেশে নাটকের চেয়ে অনেক পুরনো সাহিত্যকর্ম হলো বিভিন্ন পালা। বিশেষ করে মিথ নির্ভর পালা গুলো অত্যন্ত প্রাচীন।অষ্টম ও নবম শতকে এ দেশে পালাগানও পালার অভিনয় বেশ প্রচলিত ছিল।শ্রী  চৈতন্যদেবের আর্বিভাবের আগে রাঢ়,বঙ্গ, সমতট, গৌড়, পুন্ড, চন্দ্রদ্বীপ, হরিকেল, শ্রীহট্ট সহ সমগ্র ভূ-খন্ডে পালাগানও কাহিনী কাব্যের অভিনয় প্রচলিত ছিল। ধর্মীয় বা কোনো উৎসবে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার যে রীতি সেখানে থেকেই যাত্রা শব্দটি এসেছে। এ দেশে প্রাচীন কালে বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী অভিনয় করে দেখানো হতো। সেখান থেকেই যাত্রার উৎপত্তি।

এই উপমহাদেশে নাটক বলি, যাত্রা বলি বা চলচ্চিত্র বলি এসবের অগ্রপথিক হলেন হীরালাল সেন (১৮৬৬-১৯১৭)। মানিকগঞ্জে জন্ম নেওয়া এই বিরল নাট্য প্রতিভা কোলকাতায় ঊনিশ শতকের শেষ দিকে নাটক ও চলচ্চিত্রের গোড়াপত্তন করেছিলেন। তিনি প্রথমে মিথ নির্ভর পালা তৈরি করেন। তিনিই প্রথম এই উপমহাদেশে বিজ্ঞাপন চিত্র নির্মাণ করেছিলেন।

ঊনবিংশ শতকের শেষে এবং বিশ শতকের শুরুর দিকে যাত্রায় দেশপ্রেম মূলক কাহিনীর অভিনয় শুরু হয়। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন মুকুন্দ দাস। তিনি নাটকও যাত্রার মাধ্যমে দেশপ্রেম ও ব্রিটিশ বিরোধী চেতনা তুলে ধরেন। পরে আমরা দেখেছি কৃষ্ণকমল গোস্মামী, মনোমোহন বসু, নফরউদ্দিন, মীর মোশারফ হোসেন তারা রূপকথা ভিত্তিক অনেক পালা রচনা করেছেন। সত্তর দশক থেকে নব্বইয়ের দশকে গ্রামেগঞ্জে অনেক পালা শিল্পী অনেক পালা করেছেন এবং তারা সফল ভাবে এসব পালা মঞ্চস্থ করে দর্শকমহলে বেশ সাড়াও ফেলেছিলেন। তাদের মধ্যে চট্টগ্রামের অমলেন্দু বিশ্বাস,মানিকগঞ্জের ধানেশ্বরের আব্দুল করিম, নরসিংদীর মো:জালাল উদ্দিন, হীরেন্দ্র কৃষ্ণদাস, সন্তোষ শীল, অনুপ ভৌমিক, মুন্সিগঞ্জের রফিকুল, পটুয়াখালীর সেকান্দর মাস্টার, খুলনার ডুমুরিয়ার এম এ মজিদ, ময়মনসিংহের নান্দাইলের কফিল উদ্দিন ও মানিকগঞ্জের ডা.আবেদ আলী অন্যতম। তাদের সমসাময়িক অনেক আধুনিক নাট্যকার মঞ্চনাটক ও থিয়েটার আন্দোলন করে সারা দেশে খুব সাড়া ফেলেছেন। তাদের মধ্যে নাট্যকার সেলিম আল দ্বীন, মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, মামুনুর রশীদ ও সৈয়দ শামসুল হক প্রমুখ অন্যতম। তাদের নাটকে ওঠে এসেছে শ্রেণী সংগ্রাম,ভুখা-নাঙ্গা মানুষের আকুতি ও রাষ্ট্রীয় শোষণ বঞ্চনার ইতিহাস। তবে তাদের নাটকের ভাষা, প্রকাশ ভঙ্গি ও আবহ বোঝার সাধ্য গ্রামের সাধারণ জনগণের কমই ছিল। গ্রামের শ্রমজীবী মানুষ, সহজ সরল মানুষের বিনোদন হলো অনেক আওয়াজে, অনেক আলোতে, অনেক দর্শকের সামনে মঞ্চায়িত যাত্রাপালা, বাউল গান, কীর্তন ও জারি সারি গান।

বাংলাদেশের যাত্রাশিল্পের কথা বলতে গেলে নরসিংদীর মো: জালাল উদ্দিনের কথা বলতে হয়। তিনি এক বিরলপ্রজ নাট্যকার, যাত্রাপালা রচয়িতা ও নাট্য নির্দেশক। মো:জালাল উদ্দিনের জন্ম ১৯৩৯ সালের ১২ জানুয়ারি নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার হাইরমারা গ্রামে। তার পিতার নাম হাজী নায়েব আলী ও মাতার নাম জামিলা খাতুন। পিতা হাজী নায়েব আলী ছিলেন একজন পরহেজগার সচ্ছল সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। মো:জালাল উদ্দিন ছাত্রাবস্থায় নাটক লিখে হাত পাকান। মাধ্যমিকের গন্ডি পেরোনো বিশ-বাইশ বছরের ছেলেকে গ্রামের মানুষের অভিযোগে ত্যাজ্য করতে চেয়েছিলেন পিতা হাজী নায়েব আলী। গ্রামের মানুষ তখন বলতে ছিলেন,"আপনি নামাজ পড়েন, হজ্ব করেছেন, ইমানদার লোক অথচ আপনার ছেলেটা নাটক করে বেড়ায়, এটা কেমন কথা'?

মানুষের এমন অভিযোগে পিতা খুব অতিষ্ঠ হয়ে একদিন খুব চুপিসারে পুত্রের নাটকের রিহার্সেল দেখলেন। নাটকের নাম "গাঁয়ের বুকে"। পিতা হাজী নায়েব আলী খুব মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করলেন নাটকে বা যাত্রাপালায় খারাপ কোনো কিছু করা হচ্ছে না,বরং নাটকে তুলে ধরা হয়েছে তৎকালীন সামাজিক অবিচার, অনাচার, কুসংস্কার ও নানা অসঙ্গতি। সেই থেকে এক অদৃশ্য পারিবারিক সনদ যেনো পেয়ে যান নাট্যকার মো:জালাল উদ্দিন।

মো:জালাল উদ্দিনের শৈশবজীবন গ্রামীণ গন্ধ বাতাস মাখা ও দুরন্তপনায় ঠাসা। জন্ম হাইরমারা গ্রামে হলেও তার শিক্ষা জীবন শুরু হয়েছে চরসুবুদ্ধি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় দিয়ে, তারপর পড়ালেখা করেন চরসুবুদ্ধি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। তিনি কিছুদিন পড়াশুনা করেছেন কিশোরগঞ্জের কটিয়াদির আচমিতা উচ্চ বিদ্যালয়ে তার খালার বাসায় থেকে। তারপর মেট্রিকুলেশন পাশ করার পর ভর্তি হন নরসিংদী সরকারি কলেজে। নরসিংদী কলেজে পড়ার সময় তিনি কলেজ ছাত্র সংসদের নাট্যও প্রমোদ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং ঐ সময় কলেজ সাময়িকীতে প্রকাশিত হয় তার প্রথম নাটক "অপ্রত্যাশিত"। সেই থেকেই নাট্যজগতে তার শুভযাত্রা। তারপর তিনি রচনা করেন সমাজ সংস্কারমূলক নাটক "গাঁয়ের বুকে" মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক নাটক "দুই ভাই" "রক্তরাঙা বাংলাদেশ" ইত্যাদি। এমন কী সত্যজিৎ রায়ের মতো নারী বিবর্জিত নাটকও রচনা করেছেন তিনি। নাট্যজগতে কাজ করতে গিয়ে জীবনের চড়াই উৎরায়ে তিনি এক সময় যাত্রাশিল্পের সঙ্গে যুক্ত হন এবং অনেক গুলো যাত্রাপালা রচনা করেন। তার রচিত যাত্রাপালা গুলোর মধ্যে "ভিখারীর ছেলে" খুবই জনপ্রিয় পালা,যার মুদ্রণ সংখ্যা আট লক্ষেরও বেশি।এই যাত্রা পালাটি বাংলাদেশের বাইরে আসামও কোলকাতায়ও মঞ্চস্থ হয়েছিল। তার রচিত নাটক ও যাত্রাপালার মধ্যে গাঁয়ের বুকে, ভিখারীর মেয়ে, ভিখারীর ছেলে, দুই ভাই, রাজরক্ত, রাজ্যহারা, মালির ছেলে, রক্ত রাঙা বাংলাদেশ, কিছু খেতে দাও, মাঝির মেয়ে, কুসুম তারা, প্রীতিবন্ধন, রঙিলা একটি মেয়ের নাম, ডাকাত, লুন্ঠিত দেবমন্দির ও অনেক আঁধার অন্যতম। তিনি সারা বাংলাদেশে যাত্রাপালা পরিষদের সভাপতিও ছিলেন।

তিনি নরসিংদী গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের অগ্রপথিক।তিনি নরসিংদী গ্রুপ থিয়েটারের গোড়াপত্তন করেছিলেন। নরসিংদীর প্রথম গ্রুপ থিয়েটার সংগঠন তরঙ্গ নাট্যগোষ্ঠী, কল্লোল নাট্য সংস্থা ও সাম্প্রতিক নাট্য গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন তিনি।

বিশাল সংসারের (৮ ছেলে ৫ মেয়ে) চাকা সচল রাখতে ছুটেছেন দিক্বিদিক। কিছু দিন কাজ করেছেন চলচ্চিত্র সাংবাদিক হিসাবে। জনপ্রিয় চলচ্চিত্র পরিচালক ইবনে মিজানের সহকারী হয়ে কাজ করেছেন বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে। নাট্য নির্দেশনা ও যাত্রাপালা পরিচালনার পাশাপাশি "মঞ্চরূপা" নামে একটি দোকান ছিল যেখানে থেকে তিনি মঞ্চনাটক ও যাত্রাপালার সরঞ্জামাদি ভাড়া দিতেন। নাটক ও যাত্রাপালা নির্দেশনা ও পরিচালনা করে কিছু অর্থ পেতেন আর নাটক ও যাত্রাপালার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ভাড়া দিয়ে কিছু আয় করতেন। তাই এই নাট্যকারের সংসার জীবন তেমন সচ্ছল ছিল না। তবে তার ছেলে-মেয়েরা কেউ সংগীত শিল্পী, কেউ অভিনেত্রী, কেউ তালযন্ত্রী, কেউ সাউন্ড ডিরেক্টর হওয়ায় তারা সংসারের কিছুটা আর্থিক দুরবস্থা দূর করেছেন। তাই তার পরিবারকে বলা যায় একটি আদর্শ সংস্কৃতি ঋদ্ধ পরিবার।

মো:জালাল উদ্দিন শেষ বয়সে বেশ কিছু সমাজহিতৈষী কাজ করেছেন। প্রায় একক প্রচেষ্টায় নিজ এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেছেন চরসুবুদ্ধি জুনিয়র স্কুল। নির্মাণ করেছেন দৃষ্টি নন্দন মসজিদ। এলাকায় শিক্ষা বিস্তারে ও আর্থ মানবতার সেবায় হাত প্রসারিত করেছেন বারবার। তার কর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। এসবের মধ্যে নরসিংদী মুক্তধারা নাট্য সম্প্রদায় সম্মাননা-১৯৯৫,অধ্যাপক শাহ হালীমুযযামান সম্মাননা-২০১২, বেলাব কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ গুণীজন সম্মাননা-২০১২, যাত্রাপালা সম্রাট ব্রজেন্দ্র কুমার দে স্মৃতি পদক-২০১৩, নরসিংদী শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃক নাট্যাঙ্গন সম্মাননা-২০১৫, নরসিংদী ব্র্যান্ড মিউজিক এসোসিয়েশন সম্মাননা-২০০৯, নরসিংদী নীলাম্বরী ললিতকলা একাডেমি সম্মাননা-২০১৪, রায়পুরা চরসুবুদ্ধি ইউনিয়ন পরিষদ সম্মাননা-২০১৫ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। আরো পেয়েছেন নরসিংদী জেলা গ্রুপ থিয়েটার সম্মাননা ও স্বরলিপি শিল্পী গোষ্ঠী সম্মাননা।

তিনি অনেকবার ঢাকা শিল্পকলা একাডেমিতে নাকট মঞ্চায়নে নরসিংদীর প্রতিনিধিত্ব করে পুরস্কৃত হয়েছেন। তার অনেক নাটক সারাদেশে মঞ্চস্থ করার জন্যে বাংলাদেশে শিল্পকলা একাডেমির সেন্সরবোর্ড অনুমতি দিয়েছে। তার বড় ছেলে শফিকুল ইসলাম ভূইয়া লিটন জানান, "বাবার অনেক গুরুত্বপূর্ণ বই,দলিল, পান্ডুলিপি ভর্তি একটি ট্রাংক চুরি হয়ে যাওয়াতে বাবার অনেক এবং আমাদের পরিবারের বিশেষ ক্ষতি হয়ে গেছে"। এই মহান নাট্যকার ও যাত্রাশিল্পী নরসিংদী তথা সারা বাংলাদেশের গর্ব।

লেখক: কবি ও লেখক


বিভাগ : মতামত


এই বিভাগের আরও