জাতীয় ফল কাঁঠালের পুষ্টিগুন ও স্বাস্থ্য উপকারিতা...

২০ জুন ২০২০, ১২:২৬ এএম | আপডেট: ২৮ মার্চ ২০২৪, ১২:৩৫ পিএম


জাতীয় ফল কাঁঠালের পুষ্টিগুন ও স্বাস্থ্য উপকারিতা...

জীবনযাপন ডেস্ক:

গ্রীষ্ম মানেই ফলের মৌসুম। আম, কাঁঠাল, লিচু, জাম, তরমুজ ইত্যাদি রসালো ফল সহজলভ্য এই মৌসুমে। একেক ফলের রয়েছে একেক পুষ্টিগুণ। প্রতিটি মৌসুমি ফলই শরীরের নানা রকম ভিটামিন ও খনিজের অভাব পূরণ করতে সাহায্য করে। আর আমাদের জাতীয় ফল কাঁঠালেরও রয়েছে নানা গুণাবলী। কাঁঠাল একটি সুস্বাদু রসালো ফল।

কাঁঠাল বাংলাদেশের জাতীয় ফল, এর ইংরেজী নাম হচ্ছে (Jackfruit)। এর বৈজ্ঞানিক নাম Artocarpus heterophyllus মোরাসিয়া পরিবারের আর্টোকার্পাস গোত্রের ফল। এক প্রকারের হলদে রঙের সুমিষ্ট গ্রীষ্মকালীন ফল। এটি বাংলাদেশের জাতীয় ফল হিসেবে সরকারীভাবে নির্ধারিত। বাংলাদেশের সর্বত্র কাঁঠাল গাছ পরিদৃষ্ট হয়। কাঁচা কাঁঠালকে বলা হয় এঁচোড়। কাঁঠাল গাছের কাঠ আসবাবপত্র তৈরীর জন্য সমাদৃত। কাঁঠাল পাতা বিভিন্ন প্রাণীর পছন্দের খাদ্য। তুলনামূলকভাবে বিশালাকার এই ফলের বহির্ভাগ পুরু এবং কান্টকাকীর্ণ, অন্যদিকে অন্তরভাগে একটি কাণ্ড ঘিরে থাকে অসংখ্য রসালো কোয়া। কাঁঠালের বৃহদকার বীজ কোয়ার অভ্যন্তরভাগে অবস্থিত।

ভারতীয় উপমহাদেশ বিশেষত বাংলাদেশ ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহে কাঁঠালের উৎপত্তি স্থান হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশ, আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, দক্ষিণ ভারত, বিহার, মায়ানমার, মালয়, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি এলাকা ছাড়া বিশ্বের আর কোথাও এরূপ ব্যাপকসংখ্যায় কাঁঠালের চাষ করতে দেখা যায় না। তবে ব্রাজিল, ওয়েস্ট ইন্ডিজের জামাইকা প্রভৃতি দেশে সীমিত আকারে কাঁঠাল জন্মায়। সাধারণত লালচে মাটি ও উঁচু এলাকায় এটি বেশী দেখা যায়। বাংলাদেশের মধুপুর ও ভাওয়ালের গড়, এবং পাবর্ত্য এলাকায় কাঁঠালের চাষ বেশী হয়।

বসন্ত ও গ্রীস্মের প্রথমে কাঁচা অবস্থায় এবং গ্রীস্ম ও বর্ষায় পাকা অবস্থায় পাওয়া যায়। এ ফলটি আকারে বেশ বড় হয়ে থাকে। এর পুষ্টিগুণ রয়েছে অনেক। কাঁঠালের ৪-৫ কোয়া থেকে ১০০ কিলো ক্যালরি খাদ্য শক্তি পাওয়া যায়। এর হলুদ রঙের কোষ হচ্ছে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ। ২-৩ কোয়া কাঁঠাল আমাদের এক দিনের ভিটামিন ‘এ’ এর চাহিদা পূরণ করে। সেজন্য কাঁঠাল অপুষ্টিজনিত সমস্যা রাতকানা এবং রাতকানা থেকে অন্ধত্ব প্রতিরোধ করার জন্য খুবই উপযোগী ফল। শিশু, কিশোর, কিশোরী এবং পূর্ণ বয়সী নারী- পুরুষ সব শ্রেণীর জন্যই কাঁঠাল খুবই উপকারী ফল। গর্ভবতী এবং যে মা বুকের দুধ খাওয়ান তাদের জন্য কাঁঠাল দরকারি ফল। শরীরে ভিটামিন ‘এ’ এর অভাব দেখা দিলে ত্বক খসখসে হয়ে যায়। শরীরের লাভণ্যতা হারিয়ে ফেলে এজন্য কাঁঠাল প্রতিরোধ করতে পারে। এ ছাড়া কাঁঠালের মধ্যে ভিটামিন ‘সি’ এবং কিছুটা ‘বি’ আছে। পাকা কাঁঠাল যেমন উপকার রয়েছে, তেমনি কাঁচা কাঁঠালও কম উপকারী নয়। কাঁচা কাঁঠাল আমিষ ও ভিটামিন সমৃদ্ধ তরকারি। পাকা কাঁঠালের বিচি বাদামের মতো ভেজে যেমন খাওয়া যায়, তেমনি তরকারি হিসেবেও খাওয়া যায়। ১০০গ্রাম কাঁঠালের বিচিতে ৬.৬ গ্রাম আমিষ আছে ও ২৫.৮ গ্রাম শর্করা আছে। সবার জন্যই আমিষ সমৃদ্ধ কাঁঠালের বিচি উপকারী। এজন্য কাঁঠাল গাছ বেশি লাগানো উচিত। সেই সঙ্গে কাঁঠাল ফলটি খেয়ে ভিটামিন ‘এ’- এর ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব।

কাঁঠালের বেশ কিছু জাত রয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতে চাষকৃত জাতসমূহ মোটামুটি দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। গালা ও খাজা – এ দুটি জাত ছাড়াও কাঁঠালের আরো জাত আছে। গালা ও খাজা কাঁঠালের মাঝামাঝি বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হিসেবে রয়েছে ‘রসখাজা’। এছাড়া আছে রুদ্রাক্ষি, সিঙ্গাপুর, সিলোন, বারোমাসী, গোলাপগন্ধা, চম্পাগন্ধা, পদ্মরাজ, হাজারী প্রভৃতি। তন্মধ্যে শুধুমাত্র হাজারী কাঁঠাল বাংলাদেশে আছে, বাকীগুলো আছে ভারতে।

কাঁঠাল এর কিছু উপকারিতা:
# কাঁঠালে চর্বির পরিমাণ নিতান্ত কম। এই ফল খাওয়ার কারণে ওজন বৃদ্ধির আশংকা কম।
# কাঁঠাল পটাশিয়ামের উৎকৃষ্ট উৎস। ১০০ গ্রাম কাঁঠালে পটাশিয়ামের পরিমাণ ৩০৩ মিলিগ্রাম। যারা পটাশিয়াম উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। এ জন্যে কাঁঠালে উচ্চ রক্ত চাপের উপশম হয়।
# কাঁঠালে প্রচুর ভিটামিন এ আছে, যা রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করে।
# কাঁঠালের অন্যতম উপযোগিতা হল ভিটামিন সি। প্রাকৃতিকভাবে মানবদেহে ভিটামিন “সি” তৈরি হয় না। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি দাঁতের মাড়িকে শক্তিশালী করে ভিটামিন “সি”।
# কাঁঠালে বিদ্যমান ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস- আলসার, ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপ এবং বার্ধক্য প্রতিরোধে সক্ষম।
# কাঁঠালে আছে শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা আমাদের দেহকে ক্ষতিকর ফ্রির‌্যাডিকেলস থেকে রক্ষা করে। এছাড়াও আমাদেরকে সর্দি-কাশি রোগের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে।
# টেনশন এবং নার্ভাসনেস কমাতে কাঁঠাল বেশ কার্যকরী।
# বদহজম রোধ করে কাঁঠাল।
# কাঁঠাল গাছের শেকড় হাঁপানী উপশম করে। শেকড় সেদ্ধ করলে যে উৎকৃষ্ট পুষ্টি উপাদান নিষ্কাশিত হয় তা হাঁপানীর প্রকোম নিয়ন্ত্রণে সক্ষম।
# চর্মরোগের সমস্যা সমাধানেও কাঁঠালের শেকড় কার্যকরী। জ্বর এবং ডায়রিয়া নিরাময় করে কাঁঠালের শেকড়।
# কাঁঠালে আছে বিপুল পরিমাণে খনিজ উপাদান ম্যাঙ্গানিজ যা রক্তে শর্করা বা চিনির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
# কাঁঠালে বিদ্যমান ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়ামের মত হাড়ের গঠন ও হাড় শক্তিশালী করণে ভূমিকা পালন করে।
# কাঁঠালে আছে ভিটামিন বি৬ যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।
# কাঁঠালে বিদ্যমান ক্যালসিয়াম কেবল হাড়ের জন্য উপকারী নয় রক্ত সংকোচন প্রক্রিয়া সমাধানেও ভূমিকা রাখে।
# ছয় মাস বয়সের পর থেকে মায়ের দুধের পাশাপাশি শিশুকে কাঁঠালের রস খাওয়ালে শিশুর ক্ষুধা নিবারণ হয়। অন্যদিকে তার প্রয়োজনীয় ভিটামিনের অভাব পূরণ হয়।
# চিকিৎসা শাস্ত্র মতে প্রতিদিন ২০০ গ্রাম তাজা পাকা কাঁঠাল খেলে গর্ভবতী মহিলা ও তার গর্ভধারণকৃত শিশুর সব ধরনের পুষ্টির অভাব দূর হয়।
# গর্ভবতী মহিলারা কাঁঠাল খেলে তার স্বাস্থ্য স্বাভাবিক থাকে এবং গর্ভস্থসন্তানের বৃদ্ধি স্বাভাবিক হয়।
# দুগ্ধদানকারী মা তাজা পাকা কাঁঠাল খেলে দুধের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
# এই ফল আঁশালো বিধায় কোষ্ঠকাঠিণ্য দূর করে।
# কাঁঠালে রয়েছে খনিজ উপাদান আয়রন যা দেহের রক্তাল্পতা দূর করে।

কেবল কাঁঠালই স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী নয়, কাঁঠালের বিচিতেও রয়েছে অনেক গুণ। থিয়ামিন ও রাইবোফ্লেবিন নামের দুটি উপাদান পাওয়া যায় কাঁঠালের বিচি থেকে যা দেহের এনার্জির ঘাটতি দূর করে। এছাড়া কাঁঠালের বিচি থেকে পাওয়া যায় জিঙ্ক, আয়রন, ক্যালসিয়াম, কপার, পটাশিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের মতো উপাদান যা সুস্থতার জন্য আবশ্যক।

প্রতি ১০০ গ্রাম কাঁঠালের বিচিতে রয়েছে: মোট কার্বোহাইড্রেট ২৪ গ্রাম, বায়াটারি ফাইবার ২ গ্রাম, প্রোটিন ১ গ্রাম, ভিটামিন এ ২১৭ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি ৬.৭ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ৩৪ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম ৩৭ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ৩০৩ মিলিগ্রাম এবং ক্যালরি পাওয়া যায় ৯৪ মিলিগ্রাম।

খনিজ পদার্থ-১.১ গ্রাম কিলোক্যালরী-৪৮, আমিষ-১.৮ গ্রাম, শর্করা-৯.৯ গ্রাম, ক্যালসিয়াম- ২০ মি. গ্রাম, লৌহ-০.৫ মি.গ্রাম, ভিটামিন বি ১-০.১১ মি. গ্রাম, ভিটামিন বি২- .১৫ মি.গ্রাম, ভিটামিন সি-২১ মি.গ্রাম, ক্যারেটিন-৪৭০০ মাইক্রোগ্রাম, আঁশ-০.২ গ্রাম, চর্বি-০.১ গ্রাম, জলীয় অংশ-৮৮ গ্রাম।

জেনে নিন কাঁঠালের বিচির উপকারিতা সম্পর্কে:
# কোষ্ঠকাঠিন্য কমায় কাঁঠালের বিচি। এতে থাকা ফাইবার কোলোনের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধিতেও সাহায্য করে।
# কাঁঠালের বিচিতে যে পরিমাণ প্রোটিন থাকে, তা দেহের দৈনিক চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট।
# পেশি গঠনে সাহায্য করে কাঁঠালের বিচি।
# কাঁঠালের বিচি থেকে পাওয়া যায় একাধিক অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল এলিমেন্ট যা জীবাণু থেকে দূরে রাখে আমাদের।
# হজমের সমস্যা কমাতেও কাঁঠালের বিচি কার্যকর।
# প্রচুর মাত্রায় প্রোটিন এবং অন্যান্য উপকারি মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস উপাদান রয়েছে কাঁঠালের বিচিতে। এসব উপাদান মস্তিষ্কের কেমিকেল ব্যালেন্স ঠিক রাখে।
# কাঁঠালের বিচিতে রয়েছে ভিটামিন এ। দৃষ্টিশক্তির উন্নতি ঘটায় এই ভিটামিন।
# কাঁঠালের বিচি থেকে প্রচুর পরিমাণে আয়রন পাওয়া যায়। ফলে রক্তশূন্যতা থেকে রেহাই পেতে কাঁঠালের বিচি খেতে পারেন নিয়মিত।
# ত্বক উজ্জ্বল ও টানটান রাখে।

কাঁঠালের ব্যবহার:
কাঁঠাল কাঁচা ও পাকা উভয় অবস্থাতেই খাওয়া যায়। বসন্তকাল থেকে গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত কাঁচা কাঁঠাল কান্দা বা ইচোড়’ সবজি হিসেবে খাওয়া হয়। পাকা ফল বেশ পুষ্টিকর, কিন্তু এর গন্ধ অনেকের কাছে ততটা আকর্ষণীয় নয়। তবু মৃদু অম্লযুক্ত সুমিষ্ট স্বাদ ও স্বল্পমূল্যের জন্য অনেকে পছন্দ করেন। কাঁঠালের আঁটি তরকারির সাথে রান্না করে খাওয়া হয় অথবা পুড়িয়ে বাদামের মত খাওয়া যায়। এর একটি সুবিধে হল, আঁটি অনেকদিন ঘরে রেখে দেয়া যায়। পাকা ফলের কোষ সাধারণত খাওয়া হয়, এই কোষ নিঙড়ে রস বের করে তা শুকিয়ে আমসত্বের মত ‘কাঁঠালসত্ব’ও তৈরি করা যায়। এমনটি থাইল্যান্ডে এখন কাঁঠালের চিপস্ তৈরি করা হচ্ছে। কোষ খাওয়ার পর যে খোসা ও ভুতরো ( অমরা ) থাকে তা গবাদি পশুর একটি উত্তম খাদ্য। ভুতরো বা ছোবড়ায় যথেষ্ট পরিমাণে পেকটিন থাকায় তা থেকে জেলি তৈরি করা যায়। এমন কি শাঁস বা পাল্প থেকে কাচা মধু আহরণ করার কথাও জানা গেছে। কাঁঠাল গাছের পাতা গবাদি পশুর একটি মজাদার খাদ্য। গাছ থেকে তৈরি হয় মুল্যবান আসবাবপত্র। কাঁঠাল ফল ও গাছের আঁঠালো কষ কাঠ বা বিভিন্ন পাত্রের ছিদ্র বন্ধ করার কাজে ব্যবহৃত হয়।


বিভাগ : জীবনযাপন


এই বিভাগের আরও