শিক্ষায় সরকারি নীতির ধারাবাহিকতা: সাফল্য গাথা

০৫ অক্টোবর ২০১৯, ১০:৫২ এএম | আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:৪০ এএম


শিক্ষায় সরকারি নীতির ধারাবাহিকতা: সাফল্য গাথা
শিক্ষায় সরকারি নীতির ধারাবাহিকতা: সাফল্য গাথা

ড. মুহাম্মদ সোহরাওয়ার্দী

শত ঘাত-প্রতিঘাত, নানা রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বাঁধা অতিক্রম করে অদম্য মনোবলের অধিকারী বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী সশ¯্র দখলদার পাকিস্তানী বাহিনীকে পরাজিত করে ছিনিয়ে আনে লাল সবুজের বাংলাদেশ। যুদ্ধকালীন বিরোধী শক্তি নানাভাবে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে সচেষ্ট হলেও এদেশের অসম সাহসী মানুষ এগিয়ে চলেছে বুক চেতিয়ে।

যেমন কামানের গোলার সামনে চলেছেন একাত্তরে। নানা প্রাকৃতিক দূর্যোগ, মানবসৃষ্ট দূর্যোগকে মোকাবলা করে ১৬ কোটি মানুষের এ বাংলাদেশ সামনে এগিয়ে চলেছেন উন্নয়ন তাত্ত্বিকদের আশংকাকে ভুল প্রমাণিত করে। মার্কিন অর্থনীতিবিদ হলিস বি. শেরানি ১৯৭৩ সালে বলেছিলেন বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু আয় ৯০০ ডলারে পোঁছাতে ১২৫ বছর সময় লাগবে।

কিন্তু এদেশের মানুষ এ অর্থনীতিবিদের শংকাকে ভুল প্রমাণিত করে স্বাধীনতার ৪০ বছরের মাঝেই মাথাপিছু আয় ৯২৮ ডলারে উন্নীত করেন। ২০১১ সাল থেকে মাত্র ৮ বছরে ব্যবধানে মাথাপিছু আয়কে দ্বিগুণ করে বর্তমানে ১৯০৯ ডলারে উন্নীত করেছেন এদেশের খেটে খাওয়া সংগ্রামী মানুষ।  ১৯৭০ দশকে স্বাধীনতা উত্তর সময়ে যারা

বাংলাদেশকে ‘উন্নয়নের টেস্ট কেস’ বলে অভিহিত করেছিলেন সেই উন্নয়ন তাত্ত্বিকগণই এখন বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে মুগ্ধ হয়ে বাংলাদেশকে উবাবষড়ঢ়সবহঃ ংঁৎঢ়ৎরংব বলে অভিহিত করেছেন। যে বাংলাদেশের পরিচয় ছিল ভুখা-নাঙ্গা, বন্যা, সাইক্লোন, হত-দরিদ্র ও অনুন্নত দেশ, সে বাংলাদশেই এখন বিশে^র ৩০ তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ।  

সম্প্রতি প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকোনিমক ফোরামের বৈশি^ক লিঙ্গবৈষম্য প্রতিবেদনে দক্ষিণ এশিয়ায় সবার ওপরে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ। বিশে^র ১৪৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৮তম যা ২০০৬ সালে ছিল ৯১তম অবস্থানে।    

 (ক) প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়ের সমতা;

(খ) মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছেলে-মেয়ের সমতা;

(গ) সরকার প্রধান হিসেবে নারীর সময়কাল ও

(ঘ) জন্মের সময় ছেলে ও মেয়ে শিশুর সংখ্যাগত সমতা- এ ‘চার ক্ষেত্রে বিশে^ সবার সেরা বাংলাদেশ।’ 

শিক্ষা কী?

সাধারণ অর্থে জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জনই শিক্ষা। ব্যাপক অর্থে পদ্ধতিগত জ্ঞান লাভের প্রক্রিয়াকে শিক্ষা বলে। তবে শিক্ষা হলো সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের অব্যাহত অনুশীলন। অন্যভাবে বলা যায়, শিক্ষা হলো বিকশিত ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ প্রকাশ।  শিক্ষা মানুষের জীবনে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। শিক্ষাই মানব জীবনের সর্বতোমুখী বিকাশে সহায়ক। মানুষের মানবীয় গুণাবলি, সৃষ্টিশীলতা, জীবনের প্রতি মমত্ববোধ, অসাম্প্রদায়িক জীবন-জিজ্ঞাসা, যৌক্তিকতার বিকাশ-এসবই শিক্ষার মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব। সত্য-মিথ্যার পার্থক্য, ন্যায়-অন্যায় বোধ ও সুন্দর-অসুন্দরের ব্যবধান বুঝতে হলে জ্ঞানার্জনের কোনো বিকল্প নেই। এছাড়া অর্থনৈতিক বিকাশ, বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশলগত সমৃদ্ধি, জীবনের মানোন্নয়ন ও গভীর দেশপ্রেমের জন্য প্রয়োজন গুণগত শিক্ষার বিস্তার।

জ্ঞান হচ্ছে ক্ষমতার উপস্থিতির একটি প্রকাশ। সমাজে বসবাসরত মানুষের মধ্যকার পার্থক্য গুছাতে শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। পবিত্র কুরআনে তৃতীয় সর্বোচ্চ বার ব্যবহৃত শব্দ হলো ‘ইলম’ বা জ্ঞান। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ ইলম শব্দটি ৭৫০ বার তুলে ধরেছেন। জ্ঞান প্রদানই শিক্ষার একক উদ্দেশ্য নয়। শিক্ষার্থীদের নিজেদের জীবনে দিকনির্দেশনা দেওয়া ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যাতে আরো বেশি অনুসারী তৈরি করতে পারে তা নিশ্চিত করাও শিক্ষার লক্ষ্য। শিক্ষা ঐতিহ্যের সংরক্ষণ ও প্রচারে ভূমিকা রেখে থাকে।

সামাজিক উন্নয়নের একটি মৌলিক উপাদান ও সূচক হলো শিক্ষা। শিক্ষা মানুষের দক্ষতা উন্নয়নে সহায়ক। শিক্ষাকে সামাজিক উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। শিক্ষা বলতে ব্যক্তির আচরণের কাঙ্খিত, প্রত্যাশিত ও কল্যাণকর পরিবর্তনকে বোঝায়। অভিজ্ঞতা ও অনুশীলনের মাধ্যমে জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তনকে শিক্ষা বলা হয়।  অর্থাৎ শিক্ষা হচ্ছে ক্রমবিকাশের এমন একটি প্রক্রিয়া যা মানুষের শৈশব থেকে পরিণত বয়স পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত এবং এ প্রক্রিয়া দ্বারা ব্যক্তি তার শারীরিক, সামাজিক ও আধ্যাতিœক পরিবেশের সঙ্গে ক্রমশ সংগতি স্থাপন করতে সক্ষম হয়।

শিক্ষা হলো একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে শিশুদেরকে সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যক্তিত্ব উন্নয়ন, কৃষ্টিগতভাবে পরিমার্জন, আবেগে স্থিরতা, নীতিতে অটুট, মানসিকভাবে সর্তক, নৈতিকভাবে ন্যায়বাদী, দৈহিকভাবে সবল, সামাজিকভাবে দক্ষ, আধ্যাতিœকভাবে ন্যায়পরায়ণ, জীবিকার ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং আন্তর্জাতিকভাবে উদারভাবে গড়ে তোলা হয়। আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বিভিন্ন বাহনের মাধ্যমে অর্জিত সকল অভিজ্ঞতাই শিক্ষার অন্তর্ভূক্ত। 

জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে শিক্ষার কোন কোন বিকল্প নেই। দারিদ্র্য বিমোচন এবং সামাজিক উন্নয়নের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার হলো শিক্ষা। শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো মানবীয় মূল্যবোধের উম্মেষ ঘটিয়ে মানুষের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ সাধন, মানব সম্পদ ও দক্ষতার উন্নয়ন ঘটানো। সাধারণত সামাজিক বা মানব উন্নয়নে শিক্ষাকে বিবেচনার ক্ষেত্রে সাক্ষরতা, প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির প্রবণতা, মাধ্যমিক শিক্ষায় ভর্তির প্রবণতা প্রভৃতি বিষয়কে বোঝানো হয়।

বাংলাদেশের শিক্ষা কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য ২০১০ সালে প্রণীত শিক্ষানীতিতে তিন স্তরবিশিষ্ট শিক্ষা কাঠামোর কথা বলা হয়েছে। প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণিকে প্রাথমিক শিক্ষা, নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক শিক্ষা এবং উচ্চ শিক্ষা এ তিন স্তরে বিভক্ত শিক্ষা কাঠামোতে ৪ বছরের শিশুদের জন্য প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু করার কথা বলা হয়েছে। মানবতার বিকাশ এবং জনমুখী উন্নয়নে ও প্রগতিতে নেতৃত্বদানের উপযোগী মননশীল, যুক্তিবাদী, নীতিবান, নিজের ও অন্যান্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কুসংস্কারমুক্ত, পরমতসহিষ্ণু, অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমিক এবং কর্মদক্ষ নাগরিক গড়ে তোলাই এ শিক্ষানীতির মূল উদ্দেশ্য।  

শিক্ষা একদিকে মানুষের জ্ঞানের ভা-ারকে পরিপূর্ণ করে অন্যদিকে শ্রমের বর্ধিত উৎপাদনশীলতা, ভূমি ও অন্যান্য বস্তুগত সম্পদের কার্যকর ব্যবহার এবং আর্থ-সামাজিক ক্ষমতায়নে ভূমিকা রাখে। বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার মাধ্যমে একটি দেশের জাতীয় আয় দ্রুত বৃদ্ধি পায়, দারিদ্র্য বিমোচন হয় তথা উন্নয়ন সহজতর হয়। জাপানের উন্নয়নে ৮৫% শিক্ষাসংক্রান্ত মানবিক ও সামাজিক পুঁজির অবদান রয়েছে।

শিক্ষায় বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে যুগোপযোগী ও বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। শিক্ষায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলে তা গুণগত ও দক্ষ মানবিক পুঁজি তৈরি করে। এ পুঁজি ব্যবহার করে প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটিয়ে বা নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে চলমান প্রযুক্তি ও উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহার করেও উন্নয়ন সাধন সম্ভব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গত শতাব্দীর শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১৬-২০ শতাংশ ছিল।

কিন্তু যখন শিক্ষিত শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় তখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২৩ শতাংশ হারে অর্জিত হয়। কোন দেশে শিক্ষায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলে বৈষয়িক পুঁজি স্থির থাকলেও মানবিক পুঁজি বৃদ্ধি পায়। শিক্ষা শ্রমিকের জ্ঞান ও বৈষয়িক পুঁজি ব্যবহারের জন্য প্রাপ্ত প্রশিক্ষণ তাঁর উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। শিক্ষা মানুষের সবচেয়ে গুরুতপূর্ণ মৌলিক মানবাধিকার। এ মৌলিক প্রয়োজনটি পূরণ হলে মানুষের অন্যান্য অধিকার (খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা) অর্জনের পথ সুগম হয়।

একজন মানুষ আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার মধ্য দিয়ে স্বাস্থ্য সচেতন হলে তার স্বাস্থ্যসেবার সামাজিক প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পায়। স্বাস্থ্য সচেতন ব্যক্তি নিয়মিত স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যাবেন এবং সেবা পাওয়ার চেষ্টা করেন। শিক্ষা ও দারিদ্র্যর মধ্যে নেতিবাচক সম্পর্ক বিদ্যমান। একটি দেশ বা পরিবারে শিক্ষিত লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে সেই দেশ বা পরিবারের দারিদ্র্য কমে। সামাজিক পরিবর্তনে শিক্ষার ভূমিকা চূড়ান্ত পর্যায়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নকেই তরান্বিত করে।  আঠারো শতকে জাপানে স¤্রাট মেইজির শাসনামলে জাপানের শিক্ষার উন্নয়নে যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল বাংলাদেশে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব উপযোগী মানবসম্পদ তৈরিতে বিদেশ হতে অভিজ্ঞ প্রশিক্ষিত শিক্ষকদের সহায়তা নেয়া হবে বলে অর্থমন্ত্রী আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।

শিক্ষা খাতে সরকারের বিনিয়োগ: প্রাপ্তি ও সাফল্য

একটি জাতির উন্নতির চাবিকাঠি হলো শিক্ষা। মেধা ও মননে আধুনিক এবং চেতনায় একটি সুশিক্ষিত জাতিই একটি দেশকে উন্নতির শেখরে পৌঁছে দিতে পারে। সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা ও সকলের জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা দান, নিরক্ষরতা দূর করার অঙ্গীকার ঘোষিত হয়েছে। 

সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাকে প্রাধান্য দেওয়ার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার স্বাধীনতার পর পরই ১৯৭২ সালে খ্যাতিমান বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ ড. কুদরাত এ খুদার নেতৃত্বে দেশের প্রথম শিক্ষা নীতি প্রণয়ন করে।  পরবর্তীতে মফিজউদ্দিন শিক্ষা কমিশন, শামসুল হক শিক্ষা কমিশন, ড. এম এ বারী কমিশন, মনিরুজ্জামান মিঞা শিক্ষা কমিশন এবং ২০১০ সালে জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর নেতৃত্বে শিক্ষা কমিশন দেশের শিক্ষার উন্নয়নে বিভিন্ন প্রস্তাব করে। প্রত্যেক সরকারই শিক্ষার উন্নয়নে শিক্ষানীতির আলোকে শিক্ষা খাতে অর্থ বরাদ্দ করে শিক্ষার উন্নয়নে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে সরকারি বরাদ্দ প্রতি অর্থবছরে বৃদ্ধি পাওয়ায় শিক্ষার সম্প্রসারণের পাশাপাশি মানবপুঁজির বিকাশ ঘটছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ও বাজেট পর্যালোচনা করে সারণি-১.১ এ বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে বিভিন্ন অর্থবছরে রাজস্ব বাজেটের বরাদ্দ তুলে ধরা হলো:

সারণি: বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে বিভিন্ন অর্থবছরে রাজস্ব বাজেটের বরাদ্দ

 

অর্থবছর                   টাকা  (কোটি টাকা)

১৯৮৬-১৯৮৭                 ৭৪৭

১৯৯০-১৯৯১                  ১১৮২

১৯৯১-১৯৯২                  ১৩৮২

১৯৯৫-১৯৯৬                ২১৪৮

২০০০-২০০১                 ৩৫৮৭

২০০৫-২০০৬               ৬৩৪৭

২০১০-২০১১                 ১৩৮৬৭

২০১৫-২০১৬               ২৭৬০১

২০১৮-২০১৯               ২৭৯৭২

                                                                  

 সূত্র: বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০০২, পৃ. ১৫৯,

 বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৮, পৃ. ২৭৬-২৭৭।

 বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৯, পৃ. ২৮৫।

 

সারণি-১.১ এ দেখা যাচ্ছে যে, ১৯৮৬-৮৭ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে (রাজস্ব বাজেট) বরাদ্দ ছিল ৭৪৭ কোটি টাকা যা ১৯৯০-৯১ অর্থবছরে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ১৮২ কোটি টাকা। ১৯৯৫-৯৬ অর্থ বছরে শিক্ষা খাতে রাজস্ব বাজেটের বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা যা বৃদ্ধি পেয়ে ২০০০-২০০১ সালে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা। ২০০৫-২০০৬ অর্থবছরে এ বরাদ্দের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা ২০১০-২০১১ অর্থবছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১৩ হাজার ৮৬৭ কোটি টাকা যা পরবর্তী বছরে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৬০১ কোটি টাকা এবং ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৯৭২ কোটি টাকা।  ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে রাজস্ব ও উন্নয়ন বাজেটে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ২৪ হাজার ৪০ কোটি টাকা, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের জন্য ২৯ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষার জন্য ৭ হাজার ৪৫৪ কোটি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

শিক্ষায় সরকারি বরাদ্দ: সাফল্য গাথা

মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষাকে অগ্রাধিকার প্রদান করে সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকার প্রাথমিক শিক্ষায় উপবৃত্তি কার্যক্রম, স্কুল ফিডিং কার্যক্রম, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা, বিদ্যালয়বিহীন গ্রামে বিদ্যালয় স্থাপন, ছাত্র-শিক্ষক সংযোগ ঘন্টা বৃদ্ধি প্রভৃতি উদ্যোগ গ্রহণ করছে। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে মোট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ৪৯ হাজার ৫৩৯টি যা বর্তমানে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ১৪৭টিতে। ১৯৯১ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির অনুপাত ছিল ৫৫ : ৪৫ যা ২০১০-২০১৭ সময়ে নিট ভর্তির হার ৯৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, ঝরে পড়ার হার ৩৯.৮ শতাংশ হতে ১৮.৮ শতাংশে নেমে এসেছে।  ১৯৯০ সালে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ছিল ১.২৫ কোটি যা ২০১৭ সালে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১.৭২ কোটি।  তাছাড়া ২০১০-২০১৭ সময়ের মধ্যে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত ৪৬.১ থেকে ৩৯.১ এ নামিয়ে আনা এবং উপবৃত্তি প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ কোটি ৩০ লাখে উন্নীত করা হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে সরকার বিদ্যালয় বিহীন গ্রামে ১ হাজার ৪৯৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ করার পাশাপাশি ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেছে। এ সময়ের মধ্যে প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে মোট ১ লাখ ৮ হাজার ২০০ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার পাশাপাশি ১ লাখ ৩ হাজার শিক্ষকের চাকরি জাতীয়করণ করা হয়েছে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার উন্নয়নের মাধ্যমে মাধ্যমিক শিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক শিক্ষাকে অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়েছে। ২০০২ সালে দেশে ১৬ হাজার ৯৫ টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ২ হাজার ৪০৯টি কলেজ, ৭ হাজার ২৭৬টি মাদ্রাসা ছিল।  ২০১৭ সালে এসব প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১৭ হাজার ৩১৫, কলেজ ২ হাজার ৫৭টি, মাদ্রাসা ৯ হাজার ৩০৩টি এবং কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৮ হাজার ৬৪৪টি।  ২০০২ সালে মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৭৭ লাখ ৪৬ হাজার ৮৮৫ জন যার মধ্যে ছাত্রী ছিল ৫২.৮%  যা ২০১৭ সালে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৯৮ লাখ ৪ হাজার ২৩৩ জন।  ১৯৯৩-৯৪ অর্থবছরে প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে ‘শিক্ষার জন্য খাদ্য কর্মসূচি’ প্রবর্তনের মাধ্যমে দরিদ্র্য পরিবারের ২১.১৩ লক্ষ শিক্ষার্থীকে খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হয় পরবর্তীতে যা উপবৃত্তি কর্মসূচিতে রূপান্তরিত করা হয় এবং ২০১৭ সাল পর্যন্ত দরিদ্র্য পরিবারের ১ সন্তান বিদ্যালয়ে প্রেরণের জন্য মাসিক ১০০ টাকা এবং একাধিক সন্তানের জন্য মাসিক ১২৫ টাকা হারে ১.৪ কোটি ছাত্র-ছাত্রীকে উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। 

নারী শিক্ষা সম্প্রসারণ, নারীদের ক্ষমতায়ন এবং উন্নয়নমূলক কর্মকা-ে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৯৩ সাল হতে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত ছাত্রীদের উপবৃত্তি কর্মসূচি চালু করা হয় যা বর্তমানেও অব্যাহত রয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৬ষ্ঠ শ্রেণি হতে¯œাতক (পাস) ও সমমান পর্যায়ে ৪১.৪৪ লক্ষ শিক্ষার্থীকে প্রায় ৮৮৩ কোটি টাকার উপবৃত্তি ও অন্যান্য সহায়তা প্রদান করা হয়েছে যার ৭৫% ছাত্রী।  অতীতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হলেও ২০১০ সাল হতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সকল শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হচ্ছে। 

প্রাথমিক শিক্ষায় ছাত্রীদের ভর্তি বৃদ্ধি: ‘এ দিন দিন নয়/আরো দিন আছে/ এদিনেরে নিয়ে যাবা সে দিনেরও কাছে.....’ বিংশ শতকের শেষ দশকে বাংলাদেশে টেলিভিশনের একটি বিখ্যাত বিজ্ঞাপনচিত্রে আব্দুল কুদ্দুছ বয়াতী গ্রাম বাংলার মেঠো পথে নেচে গেয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুলে পাঠাতে উদ্ধুদ্ধ করার কথা নিশ্চিয় আমাদের স্মরণে রয়েছে। বাংলাদেশের ন্যায় উন্নয়নশীল দেশের দরিদ্রপীড়িত পরিবারের সদস্যদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই কঠিন কাজ।

এ পরিস্থিতিতে দরিদ্র বাবা-মা তাদের সন্তান বিশেষত মেয়েদের খাদ্যের সংস্থানের জন্য অন্যের বাড়িতে কাজে নিয়োজিত করে থাকে। ফলে এ শিশুরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত থাকে। এ সংকট থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে ‘বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন’ প্রণয়ন করলেও প্রাথমিক শিক্ষায় ছাত্রীদের অংশগ্রহণ কাঙ্খিত পর্যায়ে পৌঁছে নি। ১৯৯০ এর দশকে দরিদ্র পরিবারের নারী শিক্ষার্থীদের বিশেষত ছাত্রীদের প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির হার ছিল ৪৪.৭%। সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রাথমিক শিক্ষা হতে শিক্ষার্থী বিশেষত মেয়ে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ারোধকল্পে ১৯৯৩ সালে ‘খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা কর্মসূচি’ প্রবর্তন করা হয়।

একদিকে শিক্ষা খাতে সরকারের বরাদ্দ বৃদ্ধি অন্যদিকে দরিদ্র পরিবারের ছাত্র-ছাত্রীদের খাদ্য সহায়তার প্রদানের ফলে প্রাথমিক শিক্ষায় ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। ১৯৯০ সালে যেখানে প্রাথমিক শিক্ষায় ছাত্র-ছাত্রীর অনুপাত ছিল ৫৫.৩ ঃ ৪৪.৭ যা ২০১৮ সালে এসে ৪৯.৫০ঃ ৫০.৫০। সারণি-১.২ এ প্রাথমিক শিক্ষায় ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির পরিসংখ্যান তুলে ধরা হলো:

 

 

সারণি-১.২: প্রাথমিক শিক্ষায় ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি

 

বছর       ছাত্র (লক্ষ)                         ছাত্রী (লক্ষ)                         মোট (কোটি)

১৯৯০   ৬৬.৬ (৫৫.৩%)              ৫৩.৯ (৪৪.৭%)                 ১.২০(১০০%)

 ১৯৯৫  ৯০.৯ (৫২.৬%)                ৮১.৯ (৪৮.৪%)                 ১.৭২ (১০০%)

২০০০   ৯০.৬ (৫১.৩%)                ৮৬.১ (৪৮.৭%)                  ১.৭৬ (১০০%)

২০০৫  ৮০.৯১ (৪৯.৮৭%)           ৮১.৩৪ (৫০.১৩%)           ১.৬২ (১০০%)

২০১০   ৮৩.৯৫ (৪৯.৫০%)         ৮৫.৬৩ (৫০.৫০%)        ১.৬৯ (১০০%)

২০১৫   ৯৩.৬৯ (৪৯.১৪%)          ৯৬.৯৯ (৫০.৮৬%)         ১.৯০ (১০০%)

২০১৭   ৮৫.০৮ (৪৯.৩০%)         ৮৭.৪৭ (৫০.৬৮%)         ১.৭২ (১০০%)

২০১৮   ৮৫.৩৯ (৪৯.২৫%)         ৮৭.৯৯ (৫০.৭৫%)          ১.৭৩ (১০০%)

 

                উৎস: বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০০২, ২০১৬, ২০১৯

                                      *২০০৬ ও ২০১৬ সালের তথ্য।

 

শিক্ষার/সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি: বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে শিক্ষাখাতে সরকারের বরাদ্দ ও গুরুত্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় এর প্রভাব দেশের শিক্ষার হার বা সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। নিচের সারণিতে বাংলাদেশের শিক্ষার হার/সাক্ষরতার হার তুলে ধরা হলো:

সারণি-১.৩: শিক্ষার/সাক্ষরতার হার

 

বছর                                                       সাক্ষরতার হার

১৯৯০                                                   ৩৫.৩২

১৯৯৫                                                   ৪৭.৩

২০০০                                                   ৬৪.০০

২০০৫                                                  ৫২.৩

২০১০                                                   ৫৫.৬

২০১৫                                                   ৬৩.৬

২০১৭                                                   ৭১

২০১৮                                                   ৭২.৩

                                            

                                                  উৎস: বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০০২, ২০১৬, ২০১৯

 

সারণি-১.৩ এ দেখা যাচ্ছে যে, ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার ছিল ৩৫.৩২% যা প্রতি বছরই  ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৮ সালে দেশে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৭২.৩%।

 

স্বাস্থ্য সূচকে উন্নয়ন: বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে সরকারের বরাদ্দ বৃদ্ধি পাওয়ায় এর ইতিবাচক প্রভাব দেশের স্বাস্থ্যখাতের বিভিন্ন সূচকে লক্ষণীয়। শিক্ষা মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। বাংলাদেশে শিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাওয়ায় এর প্রভাব দেশের স্বাস্থ্য খাতে বিশেষভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে। বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ‘স্বাস্থ্য বলতে শুধুমাত্র রোগব্যাধি বা দুর্বলতার অনুপস্থিতি নয় বরং একটি পরিপূর্ণ শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক সুস্থ অবস্থাকে বুঝায়।’ মানব উন্নয়ন বা সামাজিক উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হিসেবে স্বাস্থ্য বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশের জনগণের জন্য সুলভে মানসম্পন্ন স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও পরিবার কল্যাণ সেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণের ফলে স্বাস্থ্যখাতের বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সারণিতে স্বাস্থ্যখাতের বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের সামজিক উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরা হলো:

 

সারণি-১.৪: স্বাস্থ্য সূচকে বাংলাদেশের চিত্র

 

বছর        জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার        শিশু মৃত্যুর হার     মাতৃ মৃত্যুর হার          ডাক্তার প্রতি জনসংখ্যা

১৯৯০             ২.২৩                    ৪.১                    ৩৯.৯                            ৫৩৮০

১৯৯৫             ১.৮১                      ৪.৪                    ৪৯.৯                          ৪৯৫৫

২০০০            ১.৪৮                     ২.৩                  ৫৩.৮                             ৩৯৭৭

২০১০             ১.৩৬                    ১.৯৩                ৫৬.৭                              ২৮৬০

২০১৫           ১.৩৭                       ১.৮১                 ৬২.১                              ২৬২৮

২০১৬            ১.৩৬                    ১.৭৬                ৬২.৩                               ২০৩৯

২০১৭            ১.৩৭                     ১.৭২                 ৬২.৫                               ১৭২৪

                   

        উৎস: বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০০২, ২০১৬, ২০১৭, ২০১৯ ও বাজেট বক্তৃতা ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০।

 

সারণি-১.৪ তে দেখা যাচ্ছে যে ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ২.২৩ শতাংশ যা ২০১৭ সালে ১.৩৭ শতাংশে নেমে এসেছে। শিশুমৃত্যুর হার(প্রতি হাজার জীবিত জন্মে) ১৯৯০ সালে ছিল ৯২ জন যা ২০১৬ সালে ২৪ জনে নেমে এসেছে। তাছাড়া ১৯৯০ সালে মাতৃমৃত্যুর হার (প্রতি হাজার জীবিত জন্মে) ছিল ৪.১% যা ২০১৭ সালে নেমে এসছে ১.৭২ শতাংশে। গর্ভনিরোধক ব্যবহারকারীর হার ১৯৯০ সালে ছিল ৩৯.০% যা ২০১৭ সালে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৬২.৫ শতাংশে। গর্ভনিরোধক সামগ্রী বৃদ্ধির ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রবণতা হ্রাস পেয়েছে। তাছাড়া ২০০০ সালে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যহারকারীর হার ছিল ৪০.৩% যা ২০১৭ সালে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৭৬.৮ শতাংশে। ১৯৯০ সালে ডাক্তার প্রতি জনসংখ্যা ছিল ৫৩৮০ জন। ডাক্তার নিয়োগ বৃদ্ধির ফলে ২০১৮ সালে ডাক্তার প্রতি জনসংখ্যার অনুপাত কমে দাঁড়িয়েছে ১৭২৪ জন।

দারিদ্র্য বিমোচন: সাধারণত দারিদ্র্য বলতে এমন একটি অবস্থাকে বুঝায় যখন মানুষ তার উর্পাজন দ্বারা জীবন ধারণের মৌলিক প্রয়োজনগুলো মিটাতে পারে না। অর্থাৎ প্রয়োজনীয় খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা প্রভৃতি মৌলিক চাহিদা পূরণের অক্ষমতাই হল দারিদ্র্য।

বিশ্বব্যাংক দারিদ্র্যের সংজ্ঞা দিয়েছে এভাবে “অনুন্নত জীবনযাত্রার মানই দারিদ্র্য”।

সম্প্রতি বিশ্ব ব্যাংক বলেছে “যারা দৈনিক ১.২৫ মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ আয় করতে পারে না তারাই দরিদ্র।”

বাংলাদেশের পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় দারিদ্র্যের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়,“দারিদ্র্য বলতে জীবনযাত্রার ন্যূনতম মানের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদের মালিকানা ও ব্যবহারের অধিকার হতে বঞ্চিত মানুষের অর্থনৈতিক সামাজিক ও মানসিক অবস্থাকে বুঝায়।”

সুতরাং দারিদ্র্য হল একটি বহুমাত্রিক অর্থনৈতিক সমস্যা যার মধ্যে আয়, ভোগ, পুষ্টি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান, নিরাপত্তা প্রভৃতি মৌলিক প্রয়োজন মিটাতে মানুষ অপারগ হয়।

বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচন প্রায় সমার্থক। তাই বাংলাদেশের উন্নয়ন কৌশলের মধ্যে দারিদ্র্য বিমোচন একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য। শিক্ষার প্রসার, শিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির ফলে নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষিত মানুষের হাত ভিক্ষিুকের হাত না হয়ে কর্মীর হাতে রূপান্তরিত হয়েছে। সরকারি পর্যায়ে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের প্রবণতা হ্রাস পেয়েছে যা দেশের সামাজিক উন্নয়নকে তরান্বিত করছে। জনসংখ্যার ভিত্তিতে ১৯৭১ সালে বাংলাদশে ছিল বিশে^র দ্বিতীয় বৃহত্তম দরিদ্রপীড়িত রাষ্ট্র। বর্তমানে ১৫৪টি দরিদ্রপীড়িত রাষ্ট্রের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৬৪ তম।  সারণি-১.৫ এ বাংলাদেশের দারিদ্র্যের অবস্থা সম্পর্কিত তথ্য তুলে ধরা হলো:

 

সারণি-১.৫: বাংলাদেশের দারিদ্র্যের অবস্থা

 

বছর       দরিদ্র জনসংখ্যার হার    অতিদরিদ্র জনসংখ্যার হার

১৯৯০              ৫৮.৮                          ২৮

১৯৯৫              ৪৭.৫                          ২৫.১

২০০০               ৪৪.৩                            ২০

২০১০               ৩১.৫                            ১৭.৬

২০১৫               ২৬                                ১৩.৮

২০১৬             ২৪.৮                               ১২.৯

২০১৭              ২৪.৩                              ১২.৯

২০১৮              ২১.৮                              ১১.৩

                          

                              উৎস: বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০০২, ২০১৬, ২০১৮, ২০১৯ এবং

                                     বাজেট বক্তৃতা ২০১৮-১৯।

 

সারণি ১.৫ এ দেখা যাচ্ছে যে, ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৫৮.৮% দরিদ্রসীমার নিচে বসবাস করত এবং অতিদরিদ্রের হার ছিল ২৮ শতাংশ। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে ২০১৬ দারিদ্র্যে প্রবণতা কমে দাঁড়িয়েছে ২৪.৮% এবং অতিদরিদ্রের হার কমে দাঁড়িয়েছে ১২.৯ শতাংশে। বাংলাদেশে ২০০৯-১০ অর্থ বছরে অতিদরিদ্রের হার ছিল ১৮% যা ২০১৬ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ১২.৯ শতাংশ। 

 

প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল: জনগণের প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল একটি দেশের সামাজিক উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হিসেবে বিবেচিত। মানুষের আয় বৃদ্ধি, শিক্ষার হার বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যখাতে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, দারিদ্র্য প্রবণতা হ্রাস প্রভৃতি কারণে বাংলাদেশের মানুষের আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি পেয়েছে। সারণি-১.৬ জনগণের প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল তুলে ধরা হলো:

 

 

সারণি-১.৬: জনগণের প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল

 

বছর       প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল (বছর)

১৯৯০           ৫৬.১

১৯৯৫          ৫৮.৯

২০০০            ৬৮

২০১০            ৬৭.৭

২০১৫            ৭০.৯

২০১৬            ৭১.৬

২০১৭             ৭২

২০১৯             ৭২.৮

                       

                                        উৎস: বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০০২, ২০১৬ ও ২০১৭

                                            এবং  বাজেট বক্তৃতা ২০১৯-২০।

 

সারণি-১.৬ দেখা যাচ্ছে যে, ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের জনগণের মানুষের প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল ছিল ৫৬.১% যা ২০১৯সালে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৭২.৮ বছরে।

 

শিক্ষা উন্নয়নের একটি গুরুত্বকপূর্ণ সূচক। উন্নয়ন আনুভূমিক ও উলম্ব পদ্ধতিতে সংগঠিত হয়। আনুভূমিক হলো সংখ্যা বা পরিমাণ বৃদ্ধির মাধ্যমে এবং উলম্ব হলো গুণ বৃদ্ধির মাধ্যমে। বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার ৭২.৩% হলেও গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে কর্মমুখী শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে সৃষ্টি করতে হবে। তাছাড়া শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ারোধ, লিঙ্গবৈষম্য রোধ, শিক্ষকদের সক্ষমতা বৃদ্ধি, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান, পাঠ্যক্রমকে যুগোপযোগী করা, ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষায় প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি প্রভৃতিক্ষেত্রে সরকারের বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। শিক্ষায় বিনিয়োগের ফলাফল হাতে পেতে ১০-২০ বছর অপেক্ষা করতে হয়। শিক্ষায় সরকারের নীতির ধারাবাহিতা বাংলাদেশকে বিশ^ব্যাপী নতুনভাবে পরিচিত করেছে।

নবজাতক ও শিশুমৃত্যু রোধে বাংলাদশের সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১০ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পুরাস্কারে ভূষিত হন। স্বাস্থ্যখাতে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সেবা প্রদানের জন্য ২০১১ সালে ঝড়ঁঃয-ঝড়ঁঃয অধিৎফ অর্জন করেন। দারিদ্র্য বিমোচনে অভাবনীয় সাফল্যের জন্য ২০১৩ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পুরাস্কারে ভূষিত করেন।

জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নেতৃত্বের স্বীকৃতি হিসেবে মানীয় প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সর্বোচ্চ সম্মান পুরষ্কার লাভ করেন। 

তাছাড়া এষড়নধষ চধৎঃহবৎংযরঢ় ঋড়ৎঁস তাঁকে অমবহঃ ড়ভ ঈযধহমব হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। নারী অধিকার সুরক্ষা ও ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করায় ২০১৮ সালে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত বিশ^ নারী সম্মেলন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পুরস্কারে ভূষিত করেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সকল আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রাপ্তির সাথে বাংলাদেশে শিক্ষায় সরকারের নীতির ধারাবাহিকতা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে পুরস্কার গ্রহণ করে তিনি তাঁর দেশের মানুষের অর্জন বলে এসব জনগণকে উৎসর্গ করেছেন।

 

 


বিভাগ : মতামত


এই বিভাগের আরও