একটি সিনেমা হল এবং স্কুল পালানো বন্ধুরা

৩০ অক্টোবর ২০২২, ০৯:৪৯ পিএম | আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:৩১ পিএম


একটি সিনেমা হল এবং স্কুল পালানো বন্ধুরা
ছবির প্রচ্ছদ: সংগৃহীত ।

দরজা খুলতেই বাসায় ঢুকলো সাইফুল আর নাবিলা। তারা আমার বন্ধু। রুমে ঢুকেই তাড়া দেয়া শুরু করলো দ্রুত তৈরি হয়ে নিতে। সবাই মিলে হলে যাবে সিনেমা দেখতে। নরসিংদী পৌর শহরে কোনো সিনেমা হল নেই। তারা যাবে , জেলার রায়পুরা উপজেলার আমীরগঞ্জ রেল স্টেশনের পাশে 'ছন্দা' সিনেমা হলে । না করার জো নেই, ইচ্ছা না থাকা সত্বেও বের হলাম। পুষ্প,রুপম,পিয়াল সহ মোট ৯ জন আমরা। দলবেধে হলে ঢুকলাম । সিনেমা শুরু হলো , সিনেমার নাম 'পরাণ'। সিনেমা চলতে থাকুক, আমিসহ মোট নয়জনের ৮ জনকে হলে বসিয়ে আমি আপনাদেরকে নিয়ে যেতে যাই ঠিক ১০ বছর পেছনে।

 

২০১১ সাল, থাকি রায়পুরায় গ্রামের বাড়িতে । তখন আমি ক্লাস নাইনে। পাঠ্যবই এবং এসএসসির সিলেবাস ছাড়া সবই পড়তে ভাল্লাগতো । বাঙলা, বিজ্ঞান , ব্যবসায় শিক্ষা এসবে মোটামুটি মানিয়ে নিতে পারলেও আমার কাছে জঘন্য লাগতো ১০ মার্কের ইংরেজি রচনা। প্রতি শনিবার ইংরেজির শিক্ষক সালাম স্যার ক্লাসে এসে একে একে দাড় করিয়ে ইংরেজি রচনা পড়া ধরতেন। উইন্টার মর্নিং, মাই ফ্যাভারিট সিজন ইত্যাদি। ক্লাসে অনেকেই মুখস্থ বলতো হরহর করে, একেবারে দাড়িকমা সহ। যা আমিসহ অনেককে দিয়ে প্রায় অসম্ভব।

 

এই অবস্থা থেকে বাচতে আমি, বন্ধু হাবিব আর মনির নতুন এক চিন্তা করলাম। প্রতি শনিবার সকালে স্কুলে এসে প্রথম ক্লাস করে কমনরুমের দেয়াল টপকিয়ে আখ,ভুট্টা আর ধান খেতের আইল দিয়ে ত্রিশ মিনিট হেটে পৌছাতাম আমীরগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনে। আরও ৫ মিনিট হেটে চলে যেতাম ছন্দা সিনেমা হলে । স্কুল ড্রেস খুলে ব্যগে রেখে, ব্যগের ভেতরে থাকা টিশার্ট পড়ে ত্রিশ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে ঢুকে যেতাম হলে। দুপুর ১২ টা থেকে বিকেল ৩ টা অব্দি শো দেখে বের হয়ে আবার ত্রিশ মিনিট হেটে স্কুলে পৌছাতাম ।বিজ্ঞান ল্যাবের পাশ দিয়ে চুপিচুপি এসে পেছনের দরজা দিয়ে ক্লাসে ঢুকে দিনের শেষ ক্লাসটা করে বাড়ি ফিরতাম।

 

ক্লাস নাইন টেনে প্রায় প্রতি শনিবার এরকমটাই করতাম আমরা। এমন করতে করতে একসময় ছন্দা সিনেমা হলটা চলে আসে আমাদের দখলে। ৩ জন দিয়ে শুরু হওয়া এই দলে বন্ধুর সংখ্যা বেড়ে দাড়ায় ২৫ জনের বেশি। 'নাম্বার ওয়ান সাকিব খান' সিনেমা দেখার সময় একসাথে মোট ২৫ জন স্কুল পালিয়ে হলে গিয়েছিলাম আমরা। সবাই কিন্তু টিকিট কাটতাম না। দুই টিকিট দিয়ে তিনজন সিনেমা দেখতাম। পনেরো জন গেলে ১০ টা টিকিট কাটতাম। এগুলো হল কতৃপক্ষ মেনেও নিয়েছিলো সেসময়। ফাইটিং দৃশ্যে - "মাইর দে, জোরে , হালার পুত আরও জোরে দে।" নায়িকার দিকে নায়ক প্রেম প্রেম ভাবে তাকালে "অঅররররেরররর , সেই সেই " বলে চিৎকার করতাম আমরা। বন্ধু হাবিব প্রায়শই পড়নের টিশার্ট খুলে সিনেমার গানের সাথে নাচতো।

 

"রাকিব - সিনেমা শেষ, ওঠো । বের হতে হবে "। নাবিলার ডাকে আবার ফিরে এলাম ২০২২ এ পরাণ সিনেমার গল্পের একেবারে শেষে। ফিরে এলাম সিনেমা হলে , যেখানে মোট আট জনকে বসিয়ে রেখে ছিলাম । মোট ৯ জন হল থেকে আমরা যখন বের হলাম আমরা তখন রাত ৯টা । একটু সামনে গেলেই অটো পাওয়া যাবে। হাটছে সবাই, আমি বারবার পেছনে তাকাচ্ছিলাম , খুজছিলাম আমার স্কুল পালানো বন্ধুদের। আমি স্বার্থপরের মতো গ্রাম ছেড়েছি ২০১৫ সালে । এরপর থেকে তাদের সবার সাথে যোগাযোগ কমে যায় ।

 

ইন্টরমিডিয়েটের পর অর্থসংকটে আর পড়েশোনা হয়নি বন্ধু মনিরের। সে এখন দেশের বাইরে থাকে , বেশ ভালোই আছে। হাবিব এসএসসি পরীক্ষার টেস্টে এলাউ হয়নি , এখন রাজমিস্ত্রীর কাজ করে । তেমনি করে আলী হোসেন, খাবির ,রুহুল,তাইজুল, পিয়াস,সাহাবুল তারা সবাই কোথায় যেন !

বন্ধু, তোরা এখন কোথায়? কেমন আছিস ? আয় , আরেকবার সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখি,চিৎকার করি ,শীষ বাজাই !

 

লিখা: রাকিবুল ইসলাম
সংবাদকর্মী ,নরসিংদী।

 


বিভাগ : বিনোদন


এই বিভাগের আরও