নরসিংদী জেলা কেন বিখ্যাত ?

২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ০৫:৫২ এএম | আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:১৬ পিএম


নরসিংদী জেলা কেন বিখ্যাত ?
নিজেস্ব প্রতিবেদক [caption id="attachment_1711" align="alignnone" width="1225"] ছবিঃ সংগৃহীত[/caption] এই যে স্যার! নরসিংদীর সবজি নিয়া যান; যেমন তাজা, তেমন স্বাদ- ঢাকায় নিয়মিত বাজার করেন অথচ এসব কথা শুনেননি এমন মানুষ খুব কমই আছেন। সবজির গুণ আর মান বোঝাতে বিক্রেতা এভাবেই সার্টিফিকেট দেন। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে কাঁচাবাজারে গিয়ে যখন ঘর্মাক্ত হয়ে জুবোথোবো অবস্থা তখন সবজি বিক্রেতার এমন কথা শুনে মনটা ভরে যায়। শুধু সবজি নয়, নরসিংদীর সাগর কলা কিংবা লটকন সব কিছুই জয় করেছে দেশের মানুষের মন। শুধু কী মাটির গুণ! জেলার পানির গুণ কী কম? মেঘনার মাছের কদর আলাদা করে বলার কিছু নেই। যেসব জেলে নরসিংদী থেকে ঢাকায় মাছ নিয়ে আসেন তাদের সামনে ভিড় জমান ক্রেতারা। মেঘনার সুস্বাদু মাছের জন্য নগরবাসী একটু চড়া মূল্য দিতেও পিছপা হন না। নরসিংদীতে রয়েছে চারটি নদ-নদী। মেঘনা, হাড়িধোয়া, শীতলক্ষ্যা ও আড়িয়ালখাঁ জেলাটিকে করেছে সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা। নদ-নদীগুলোর কোনটি উত্তাল, কোনটি শান্ত-স্নিগ্ধ। নদ-নদীর বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে জেলার মানুষের বৈশিষ্ট্যের মিল আছে যথেষ্ট। কেউ এগিয়ে চলছে নীরবে, কেউবা সরবে দুই পাড় ভাঙতে ভাঙতে। নিজ জেলার প্রতি প্রতিটা মানুষেরই ভালোবাসা রয়েছে, রয়েছে আবেগ-অনুভূতি। সঙ্গত কারণেই নরসিংদীর প্রতি আমি এবং আমাদের সবারই ভালোবাসা আছে এবং থাকবেই। তাই বলে এ জেলার যেসব মন্দ দিক আছে সেগুলোও অস্বীকার করবো না। কিছুদিন আগে একজন পুলিশ কর্মকর্তা একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে নরসিংদীকে একটি `অপরাধ প্রবণ` জনপদ বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি খুবই ধীরস্থিরভাবে যখন এই মন্তব্যটি করছিলেন তখন আমার মনটি খুবই খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু পরক্ষণেই যখন ঠাণ্ডা মাথায় বিষয়টি ভাবলাম তখন মনে হলো পুলিশ কর্মকর্তাটি কী এমন অসত্য বলেছেন যে আমার মনটা এতোটা খারাপ হয়ে গেল। সম্প্রতি যেসব সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে সেই প্রেক্ষাপটে বহিরাগত কেউ এমন মন্তব্য করলে জেলাবাসী হিসেবে আমাদের মন খারাপ হতে পারে; কিন্তু একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে তো আর দোষ দেওয়া যায়না! আইন-শৃঙ্খলার অবনতি কি শুধু সাম্প্রতিক সময়েই হয়েছে? আগে কি হয়নি?  যে কয়দিন তিনি এ কথাটি বলেছেন সবদিনই দেখা যেতো সত্যি সত্যি নরসিংদীরই ঘটনা। মনকে সান্ত্বনা দিতাম ভালো-মন্দ মিলেই আমার নরসিংদী। হিসাব-নিকাশ করে দেখতাম যে কিছু কিছু মন্দ দিক থাকলেও সার্বিক বিবেচনায় আমার জেলার ভালো দিকটাই বেশি। আজও উচ্চস্বরে মনের মধ্যে জোর নিয়ে বলতে চাই- নরসিংদীই সেরা, সবকিছুতেই সবার সেরা। লড়াই-সংগ্রাম, সাহিত্য-সংস্কৃতি, শিক্ষা-গবেষণা, শিল্প-বাণিজ্য, আইন-আদালত, চিকিৎসা, স্থাপত্য, জনপ্রশাসন, রাজনীতিসহ নানা ক্ষেত্রে এ জেলার মানুষ দাপটের সঙ্গে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিয়েছেন। জেলা হিসেবে নরসিংদী অপেক্ষাকৃত নতুন হলেও ঐতিহ্যের দিক থেকে অনেক পুরনো। [caption id="attachment_1712" align="alignnone" width="1225"] ছবিঃ সংগৃহীত[/caption] আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন নগরীর প্রত্ন নিদর্শন তো নরসিংদীরই উয়ারী-বটেশ্বর। উয়ারী-বটেশ্বর ছাড়াও জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রাগৈতিহাসিক অনেক গৌরবোজ্জ্বল নিদর্শন রয়েছে। আন্দোলন-সংগ্রামে রয়েছে নরসিংদীর অনেক কীর্তিগাথা। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ইতিহাসের নানা বাঁকবদলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন এ জেলার মানুষ। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সুন্দর আলী গান্ধীর মতো অনেক অহিংস আন্দোলনে যেমন নেতৃত্ব দিয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন, তেমনি সতীশ পাকরাশির মতো কয়েকজন বিপ্লবী সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে নিজেদের নাম গণমানুষের হৃদয়ে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে যুক্তফ্রন্ট সরকারর উত্থান-পতনের ইতিহাস অনেকেরই জানা। ওই সময় যে রাজনৈতিক সঙ্কট তৈরি হয় সেই পরিস্থিতিতে কিছুদিনের জন্য তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নরের যে গুরু দায়িত্ব পালন করেছিলেন তাঁর নাম সুলতানউদ্দিন আহমদ। তিনিও তো আমাদের নরসিংদীরই সন্তান। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের কথাই ধরা যাক। স্বৈরাচার আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের প্রাণপুরুষ শহীদ আসাদুজ্জামান। শহীদ আসাদ তো নরসিংদী জেলার শিবপুরেরই গর্বিত সন্তান। মহান মুক্তিযুদ্ধেও এ জেলার মানুষের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। প্রতিটা গ্রাম থেকে সাহসী তরুণেরা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ নিয়ে মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসকে মহিমান্বিত করেছেন। বরেণ্য রাজনীতিবিদ আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস দেশের অভ্যন্তরে বিপ্লবী কায়দায় গেরিলা যুদ্ধের যে অনন্য নজির স্থাপন করেছিলেন তা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে। মুক্তিযুদ্ধের সর্বোচ্চ খেতাব বীরশ্রেষ্ঠ অর্জন করেছেন রায়পুরার সূর্যসন্তান শহীদ মতিউর রহমান। তিনি শুধু জেলাবাসীর নন- গোটা জাতির গর্ব। একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনীর দোসরদের হাতে যে কয়জন সেরা বুদ্ধিজীবী প্রাণ বিসর্জন দেন সেখানে নরসিংদীর দুজন শ্রেষ্ট সন্তানও রয়েছেন। তাঁরা হলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন অধ্যাপক গিয়াস উদ্দীন আহমদ ও ড. সাদত আলী। পরবর্তীতে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও এ জেলার সংগ্রামী মানুষের রয়েছে গৌরবজনক ভূমিকা। মেধার দিক থেকেও নরসিংদীর মানুষের অবদান রাখার সুযোগ হয়েছে অনেক আগে থেকেই। পবিত্র আল কোরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদ করে অমর হয়ে আছেন পাঁচদোনার গিরিশচন্দ্র সেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ জেলার অনেকেই অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে শিক্ষকতা করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের পৈতৃক ভিটা রায়পুরায়। এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই আরেক খ্যাতিমান ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান। প্রয়াত এই মনীষী ছিলেন মনোহরদীর কৃতী সন্তান। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম আসাদুজ্জামান শিক্ষাজগতের আরেক উজ্জ্বল নক্ষত্র। অকালপ্রয়াত এই মহান শিক্ষক জন্মগ্রহণ করেছিলেন শিবপুরের মাটিতে। শুধু দেশ নয়- দেশের বাইরেও এ জেলার মানুষ নিজের মেধায় উজ্জ্বল হয়েছেন। উদাহরণ হিসেবে কানাডার কার্লটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মীজান রহমানের নাম উল্লেখ করার মতো। রায়পুরার হাসনাবাদে যার শেকড় সেই মহান শিক্ষাবিদ গণিতশাস্ত্রে যে বিশেষ অবদান রেখেছেন তা অতুলনীয়। তাঁর উদ্ভাবিত থিওরি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গুরুত্বের সঙ্গে পড়ানো হয়। এবারের এইচ এস সি পরীক্ষায় সারাদেশে সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে নিজেদের সামর্থের পরিচয় দিয়েছে নরসিংদীর আবদুল কাদির মোল্লা সিটি কলেজের মেধাবী শিক্ষার্থীরা। ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো প্রাথমিক শিক্ষা সমাপণী পরীক্ষায় সারা দেশের মধ্যে প্রথম হয়ে সব মানুষের মনোযোগের কেন্দ্রে এসেছিল মনোহরদীর সাদিয়া শিকদার। সেই পরীক্ষায় সপ্তম স্থান পেয়েছিল একই স্কুলের মুন ইসলাম। সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নরসিংদীর ভূমিকার কথা তো সবারই জানা। দেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমানের পৈতৃক বাড়ি রায়পুরার চরাঞ্চল পাড়াতলী গ্রামে। কবির অমর দুই কবিতা দস্বাধীনতা তুমিদ ও দতোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতাদ পাড়াতলীর পুকুরঘাটে বসে লেখা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কবি গ্রামের বাড়িতেই ছিলেন। আহ, রায়পুরার মাটি ও আলো-বাতাসের কী গুণ! সব্যসাচি লেখক অধ্যাপক ড. আলাউদ্দিন আল আজাদের জন্মস্থানও রায়পুরার রামনগরে। ভাষাবিদ অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান, লেখক-গবেষক অধ্যাপক ড. সফিউদ্দিন আহমদের মতো সাহিত্যিকদের নিয়ে আমরা সবাই গর্বিত। [caption id="attachment_1713" align="alignnone" width="400"] ছবিঃ সংগৃহীত[/caption] এখানে আরেক কৃতী শাহাবুদ্দীন আহমদের নাম না বললেই নয়। তিনি প্যারিসে বসবাস করেন। বর্তমান বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় চিত্রশিল্পীদের মধ্যে তিনি অন্যতম। বলার অপেক্ষা রাখে না তিনিও নরসিংদীর মানুষ। এদিকে, চলচ্চিত্র অঙ্গনে তাহের চৌধুরী ও আখতারুজ্জামানের দৃপ্ত পদচারণা খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। তাদের বাড়িও রায়পুরায়। তথ্য প্রযুক্তির প্রসার ঘটিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নরসিংদীর ঐতিহ্য বিশ্বজুড়ে তুলে ধরছে আমরা মনোহরদীর পরিবার নিউজ পোর্টাল  নরসিংদীর অনেকেই জনপ্রশাসনেও যথেষ্ট সুনাম ও দাপটের সঙ্গে কাজ করেছেন, এখনও করছেন। এমন কী প্রথম বাঙালি আইসিএস স্যার কে জি গুপ্তের বাড়িও নরসিংদীর পাঁচদোনায়। বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞার বাড়ি মনোহরদীতে। একাধিক সচিব ছাড়াও জনপ্রশাসনে বিভিন্ন ক্যাডারে অত্যন্ত সুনাম ও দক্ষতার সঙ্গে নরসিংদীর অনেকেই তাঁদের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। এমন কি সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে জেনারেল নূরউদ্দিন খান ও নৌবাহিনী প্রধান হিসেবে রিয়ার এডমিরাল নূরুল ইসলাম যখন দায়িত্ব পালন করেছেন তখন তাদের প্রশংসনীয় কর্মদক্ষতার কথা শোনা যেত। তারাও নরসিংদীর মানুষ। জনাব খান মনোহরদী ও জনাব ইসলাম পলাশের গর্বিত সন্তান। এছাড়াও সাবেক সচিব খোরশেদ আলম, হাবিবুর রহমান, মোহাম্মদ আলী ও মতিউর রহমানকে নিয়ে নরসিংদীবাসী সব সময় গর্ব করেন। আমাদের দেশে সাম্প্রতিক সময় পত্রিকা ও সম্প্রচার গণমাধ্যমের অনেক বিকাশ হয়েছে। এক সময় দেশে হাতেগোনা কয়েকটি পত্রিকা ছিল। সম্প্রচার গণমাধ্যম বলতে তখন বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ও বাংলাদেশ বেতার। নরসিংদীর কৃতী সন্তানেরা সব সময় অত্যন্ত নিষ্ঠা ও সুনামের সঙ্গে সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। আশির দশকে নরসিংদীর তিনজন কৃতী সন্তান তিনটি প্রভাবশালী দৈনিকে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তখন কবি শামসুর রাহমান দৈনিক বাংলা, আহমেদুল কবির দৈনিক সংবাদ ও শহীদুল হক বাংলাদেশ টাইমসের সম্পাদক ছিলেন। আহমেদুল কবির ঘোড়াশাল ও শহীদুল হক রায়পুরার ডৌকারচরের বাসিন্দা ছিলেন। মজার ব্যাপার হলো তখন অবিভক্ত বিএফইউজের সভাপতি ছিলেন নরসিংদীরই আরেক কৃতী সন্তান রিয়াজউদ্দিন আহমদ। যিনি একাধিকবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। বিটিভির মহাপরিচালক হিসেবে এক সময় দায়িত্ব পালন করেছেন মুস্তাফিজুর রহমান। তিনিও নরসিংদীর মানুষ। নরসিংদীর কৃতী সন্তানেরা জেলার গণ্ডি পেরিয়ে ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে জাতীয় পর্যায়েও নিজেদের মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব কুতুব উদ্দিন আহমদ, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক মোহাম্মদ আমিনুল হক মনি ও বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পদক আনোয়ারুল হক হেলালের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। এসবই জেলার মেধাবী মানুষদের অল্প কয়েকজনের নাম মাত্র। আরও অনেকেই এখন নিজের মেধা ও মনন শাণিত করেছেন আগামী দিনে দেশ ও জাতির সেবা দিতে। তারাও এক সময় নরসিংদী জেলার নাম উজ্জ্বল করবেন বলে আশা করি।