সবাই যখন ঈদ উদযাপনে ব্যস্ত, আর তারা দিচ্ছেন সেবা  

২২ এপ্রিল ২০২৩, ১০:৫৮ পিএম | আপডেট: ২৮ মার্চ ২০২৪, ০২:০২ পিএম


সবাই যখন ঈদ উদযাপনে ব্যস্ত, আর তারা দিচ্ছেন সেবা   

প্রণব কুমার দেবনাথ:

জরুরি সেবা হিসেবে বিবেচিত কিছু পেশার মানুষ আছেন, যাদের ঈদের দিনেও নাগরিকদের সেবা দিয়ে যেতে হয়। এক্ষেত্রে কর্মস্থলের সহকর্মীরাই হয়ে উঠেন পরিবারের সদস্য, একসঙ্গে কাজ করতে করতেই তাদের ঈদের ছুটির সময়টা কাটে। নরসিংদী শহরে ঘুরে ঘুরে ঈদের দিনে কর্মস্থলে ব্যস্ত সময় কাটানো সেই সব মানুষের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক।

 

* রোগীদের সেবা নিশ্চিত করতে পারাও ঈদের আনন্দ:

নরসিংদী সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে সবসময়ই প্রচুর রোগীর ভিড় লেগেই থাকে। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, ১০০ শয্যার এই হাসপাতালটি জেলার চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। তিনটি শিফটে সহকারীদের নিয়ে প্রতিবেলায় একজন চিকিৎসক সেখানে দায়িত্ব পালন করেন। আজ শনিবার ঈদের দিন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সেখানে গেলে দেখা যায়, জরুরি বিভাগে দায়িত্ব পালন করছেন গাইনী কনসালটেন্ট অসীম কুমার সাহা।

তিনি ২০০০ সালে রাজধানীর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এমবিবিএস পাস করেন। তার বাড়ি নরসিংদী সদর উপজেলার মাধবদীতে। সরকারী চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর থেকে গত ২০ বছর ধরে কিশোরগঞ্জ, সিলেট ও বগুড়া জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন তিনি। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার মধ্যেই 'পড়ে গিয়ে মাথা ফেটে যাওয়া' একজন রোগীকে নিয়ে আসেন স্বজনরা। এই প্রতিবেদককে সঙ্গে নিয়েই ওই রোগীর চিকিৎসা সেবা দিলেন তিনি। এ সময় চিকিৎসক অসীম কুমার সাহা বলেন, সকাল ৮টা থেকে এ পর্যন্ত জ্বর-ঠাণ্ডাসহ দুর্ঘটনায় আহত অন্তত ৩০ জন রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছেন তিনি।

অসীম কুমার সাহা বলেন, 'আমরা এমন এক সেবামূলক পেশায় আছি, যেখানে ছুটি বিষয়টিই গৌণ। জরুরি বিভাগে সাধারণত চিকিৎসা দেন মেডিকেল অফিসাররা। ঈদের ছুটিতে আমি দায়িত্ব পালন করায় আমার সহকর্মী অন্য চিকিৎসকরা ছুটি কাটাতে পারছেন, এটাও আনন্দের। এছাড়া যেসব রোগীরা আসছেন, তারা চিকিৎসা সেবা না পেলে কিভাবে হবে। তাদের সেবা নিশ্চিত করতে পারলে একধরনের ভালো লাগা কাজ করে। আমার কাছে তো মনে হচ্ছে, এটাই ঈদের আনন্দ।'

 

* আমরা কর্মস্থলে না থাকলে দুর্ঘটনায় মানুষের পাশে থাকবে কারা:

পরিবারের সদস্যদের ছাড়া কর্মস্থলে পঞ্চম ঈদুল ফিতর কাটিয়েছেন নরসিংদী ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার মো. রায়হান। তার বাড়ি চাঁদপুরের মতলব উত্তরে। অগ্নি নির্বাপণ ও উদ্ধার কাজে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য গত বছরের নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স (সেবা) পদক পান তিনি। বাড়িতে পরিবারের সবার সঙ্গে ঈদের ছুটি কাটানোর স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাওয়া আমাদের জন্য বড় বিষয় না, সেবা দেওয়াটাই বড়। কারণ আমাদের ২৪ ঘণ্টাই সতর্ক থাকতে হয়। আজ সকালেই গাজীপুরের কালিয়াকৈরে আমাদের একটি ইউনিট অগ্নি নির্বাপণ করে এসেছে। যেকোন দুর্ঘটনায় আমাদের ডাক আসে, খবর পেলেই আমরা ছুটে যাই।

মো. রায়হান বলেন, আমাদের এখানে চালক ও ফায়ার ফাইটারসহ ৩০ জনের মত জনবল রয়েছে। এখানে আমরা সবাই মিলে একটি পরিবার। ঈদ উপলক্ষে আজ এখানে ভালোমানের খাবার রান্না করা হচ্ছে। সবাই মিলে খাওয়া-দাওয়ার মাধ্যমে দিনটি উদযাপন করব। এই আমাদের ঈদের আনন্দ। তবে সরকারী নির্দেশনা অনুযায়ী ঈদের ছুটিতে ধাপে ধাপে ৩০ শতাংশ করে কর্মী বাড়ি যেতে পারেন। সেই হিসেবে আমাদের সাত-আট জন কর্মী প্রথম ধাপের ছুটি কাটাচ্ছেন। পরবর্তী দুই ধাপে বাকী কর্মীদেরও ছুটি কাটানোর সুযোগ রয়েছে।

 

* কাজ না করে ঈদের আনন্দ নিয়ে ভাবলে কী আর সংসার চলবে?

পাঁচ মাস ধরে নরসিংদী পৌরসভা সংলগ্ন ব্র্যাক ব্যাংকের এটিএম বুথে নিরাপত্ত্বার (সিকিউরিটি) দায়িত্ব পালন করছেন ষাটোর্ধ আবদুল সোবহান। আগে বিভিন্ন ধরণের চাকরি করেছেন। তার বাড়ি নরসিংদীর রায়পুরার চর আড়ালিয়ায়। বাড়িতে স্ত্রী, দুই ছেলে ও নাতি-নাতনি থাকলেও তাদের সঙ্গে ঈদ করা হচ্ছে না তার। শরীরটা কর্মস্থলে থাকলেও মন পড়ে আছে বাড়িতে।

আবদুল সোবহান বলেন, শহরের কাছেই হাজীপুর ইউনিয়নের একটি ভাড়া বাসায় থাকি। হিন্দু ধর্মাবলম্বী একজন সহকর্মীকে একঘণ্টার জন্য বসিয়ে ঈদের নামাজটা পড়ে এসেছি। যে কাজ করি, ঈদের ছুটিও পাওয়া যায় না। আমার এক ছেলে ভাঙ্গারির ব্যবসা করে, অন্য ছেলে মালামাল টানে। গরীব মানুষের আবার ঈদের আনন্দ কি? দুনিয়াতে বাঁচতে হলে চাকরি তো করতেই হইব। কাজ না করে ঈদের আনন্দ নিয়ে ভাবলে কি আর সংসার চলব?

 

* মহাসড়কে দায়িত্ব পালন করছি বলেই কিন্তু এত এত মানুষ নির্বিঘ্নে বাড়িতে গিয়ে ঈদ করতে পারছেন:

দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে শহরের জেলখানার মোড়ে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করছেন টিএসআই আয়ন চন্দ্র দে। তার বাড়ি ভোলা জেলার বোরহানউদ্দিনে। ভার্সিটি পড়ুয়া দুই ছেলেকে নিয়ে স্ত্রী থাকেন ঢাকায়। গত ১৮ মাস ধরে তিনি নরসিংদীতে চাকরি করছেন, থাকেন পুলিশ লাইনসে। এর আগে ঢাকা, গোপালগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, বান্দরবান ও পিরোজপুর ট্রাফিক পুলিশে চাকরি করেছেন তিনি।

আয়ন চন্দ্র দে বলেন, প্রায় প্রতি ঈদেই আমাকে কর্মস্থলে থাকতে হয়েছে। আমরা মহাসড়কে দায়িত্ব পালন করছি বলেই কিন্তু এত এত মানুষ নির্বিঘ্নে বাড়িতে গিয়ে ঈদ করতে পারছেন। এটাই আমাদের কাছে সবচেয়ে বড় আনন্দ। কামনা করি, বাড়িতে যাওয়া মানুষগুলো যাতে পুনরায় নির্বিঘ্নে কর্মস্থলে ফিরতে পারেন। ঈদের দিন হওয়ায় আজ মহাসড়কে যানবাহনের সংখ্যা কম। সকাল থেকে এই পর্যন্ত দেখা গেছে, দূর পাল্লার দুই-তিনটি বাস ও কিছু লোকাল বাস-মিনিবাস মহাসড়কে চলছে, তবে যাত্রীর সংখ্যা খুবই কম। ঈদের দিন দায়িত্ব পালন করছি বলে অনেকেই এগিয়ে এসে ঈদ মোবারক বলেছেন, শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এই তো আনন্দ।

 

* সাধে কি আর ঈদের দিনে কাজ করতে ইচ্ছে হয় ?

দুপুর একটার দিকে ভেলানগরে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে কথা হয় সিলেট থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী একটি বাসের চালকের সহকারী তাজু মিয়ার সঙ্গে। ৪০ বছরের এই জীবনে তিনি অনেক ধরণের কাজ করেছেন। শেষে থিতু হয়েছেন বাসের চালকের সহকারী হিসেবে। স্ত্রী-সন্তানদের ঘরে রেখে ঈদের দিন ভোরেই বাসের সঙ্গে বের হয়েছেন তিনি।

তাজু মিয়া বলেন, আজ ঈদের দিন হওয়ায় যাত্রীর সংখ্যা অর্ধেকেরও কম। গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্ম না থাকলে তো এই দিনে তারা ঢাকায় যেতেন না। আমরা গাড়ি নিয়ে বের না হলে তারা কিভাবে যেতেন, বলেন তো? আর রাস্তায় না নামলে আমরাই বা চলব কেমনে? সাধে কি আর ঈদের দিনে কাজ করতে ইচ্ছে হয়। আমরা দিনে এনে দিনে খাওয়া মানুষ, পেটের দায়ে কাজ করতে হয়।

* আরও দুইটা মেয়ের বিয়ে যে কেমনে দেব, সেটা ভাবলেই দুশ্চিন্তা হয়:

 

ভেলানগর থেকে ফেরার সময় দেখা মেলে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক চালক হাসানুল মিয়ার সঙ্গে। অন্তত ২০ বছর ধরে এই শহরে অন্যের রিকশা ভাড়ায় চালান তিনি। বাড়ি তার রংপুরের ডোমার থানায়। স্ত্রী ও তিন মেয়েকে নিয়ে তার সংসার। ঋণ করে এক মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন, আরও দুই মেয়ের বিয়ে দিতে হবে। বছরে দুইবার ধান কাটার সময়ে এলাকায় গিয়ে মাস তিনেক থেকে অন্যের ধান কেটে দেন, বাকী সময়টা নরসিংদী শহরে ইজিবাইক চালান।

ইজিবাইক চালক হাসানুল মিয়া বলেন, এলাকায় কোন কাজ নেই, তাই এই শহরে বছরের প্রায় ৯ মাস ইজিবাইক চালাই। মহাজন ভাড়া নেয় ৪০০, খাবার লাগে ২০০, হাতে থাকে ৪০০-৫০০ টাকা। ওই টাকা থেকে বেশিরভাগ বাড়িতে পাঠিয়ে দিই, না হলে সংসার চলবে না। কিছু কিছু করে ঋণ শোধেরও চেষ্টা করি। আরও দুইটা মেয়ের বিয়ে যে কেমনে দেব, সেটা ভাবলেই দুশ্চিন্তা হয়।

ঈদে বাড়ি গেলেন না কেন জানতে চাইলে তার চোখ ভিজে আসে। চোখ মুছতে মুছতে তিনি বলেন, মেয়েগুলোর জন্য খুব কষ্ট লাগে। অন্যান্য সময় বাড়িতে গেলে বাসের ভাড়া ৫০০-৬০০ টাকা লাগলেও ঈদের সময় লেগে যায় ১২০০ টাকার মত। আসা-যাওয়া ও সবকিছু মিলিয়ে অনেক টাকা লেগে যায়। এছাড়াও ঈদের এই সময়টায় মানুষ রিকশা ভাড়াও একটু বেশি দেয়। কিছু টাকা বেশি আয়ের আশায় তাই এ সময়টাতে বাড়িতে যাওয়া হয় না।


বিভাগ : জীবনযাপন


এই বিভাগের আরও